—
ইরানি যুদ্ধবাজ নেতা নাদির শাহ ১৭৩৯ সালে দিল্লি লুণ্ঠন করেন, মোগল গর্ব হিসেবে টিকে থাকা সবকিছু পদদলিত করেন। নাদির শাহ মোগল সম্রাট মোহাম্মদ শাহকে পণবন্দী করে রাখেন, আর তার সৈন্যরা দিল্লিবাসীর ওপর গণহত্যা চালায়, এর বিপুল সম্পদরাশির কোষাগার লুণ্ঠন করে। দুই মাস পর নাদির শাহ ইরান ফিরে যাওয়ার সময় সাথে করে ময়ূর সিংহাসন ও কোহিনূর হীরাসহ মোগল সার্বভৌমত্বের মহামূল্যবান প্রতাঁকের অনেক কিছু নিয়ে যান। হামলার অল্প সময় পর চিত্রিত নাদির শাহের একটি ছবিতে তাকে ভারী অলংকার, আক্ষরিকভাবেই লুণ্ঠিত মোগল সম্পদে সজ্জিত অবস্থায় দেখা যায় । নাদির শাহের হামলার পর মোগল সাম্রাজ্য সত্যিকার অর্থে আর আগের অবস্থায় ফিরতে পারেনি। ওই সময়ের এক মুসলিম বুদ্ধিজীবী বিষয়টিকে বলেছেন এভাবে : ‘দিল্লির সালতানাত হয়ে পড়েছেন শিশুর খেলনা ।’
ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ নাগাদ মোগল সাম্রাজ্য নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। তারপর ১৮৫৮ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা একটি আদালত কক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে মোগল সাম্রাজ্যের পতন ঘোষণা করে। তবে ওই পর্যায় পর্যন্ত ‘সাম্রাজ্য’ ছিল কেবল নামে। ১৭৫০-এর দশকের শেষ দিক থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভূমির মালিকানা, সেনাবাহিনী ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতাসহ সত্যিকারের সার্বভৌমত্বের প্রায় সব বিষয় করায়ত্ত করে ইতোমধ্যেই ক্ষয়ে পড়া মোগল সাম্রাজ্য আরো নিঃশেষ করে ফেলেছিল। সর্বশেষ বাদশাহর আগের জন্য তথা দ্বিতীয় আকবর শাহ (শাসনকাল ১৮০৬-৩৭) জীবন্ত জাদুঘর প্রদর্শন সামগ্রীতে পরিণত হয়েছিলেন, ব্যয়ভার মেটানোর জন্য দরবারে বিদেশী পর্যটকদের দর্শনদানের বিনিময়ে ফি গ্রহণ করতেন ।
—
কোন কারণে মোগল শক্তির পতন হলো বা ঠিক কখন মোগল সাম্রাজ্য মেরামতের অযোগ্য হয়ে ভেঙে পড়তে শুরু করল তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে বেশির ভাগ ইতিহাসবিদ মনে করেন, আওরঙ্গজেব আংশিকভাবে হলেও দায়ী। এটি একটি অদ্ভূত যুক্তি। কারণ আওরঙ্গজেবই মোগল সাম্রাজ্যকে ভৌগোলিকভাবে সর্বোচ্চ অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে আওরঙ্গজেবের সাফল্য হয়তো তার বিনাশও ছিল। তিনি সম্ভবত মোগল সাম্রাজ্যকে খুব বেশি দূর পর্যন্ত বিস্তৃত করে ফেলেছিলেন। ফলে সম্প্রসারণশীল রাজকীয় সম্পদ শিথিল হয়ে আসছিল, পুরো ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ার মুখে পড়ে গিয়েছিল ।
আরো সংশয়পূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কেউ কেউ উপস্থাপন করেছেন যে আওরঙ্গজেবের কঠোর নীতিপরায়ণতাই ছিল মরণ আঘাত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আওরঙ্গজেবের ওপর বিশ শতকের সবচেয়ে বেশি গবেষণামূলক কাজ করেছেন যে যদুনাথ সরকার, তিনি তার নিজস্ব নাটকীয় কায়দায় এভাবে বলেছেন, ‘[আওরঙ্গজেবের আমলে] মোগল আল হেলাল পূর্ণিমার চাঁদের পূর্ণতা পায় এবং তারপর দৃশ্যমানভাবেই ক্রমশ ক্ষীণজ্যোতি হতে শুরু করে।’ যদুনাথ সরকার তার পাঁচ খণ্ডের হিস্টরি অব আওরঙ্গজেবসহ এই সম্রাটকে নিয়ে লেখা অনেক গ্রন্থে আওরঙ্গজেবের দর্শন ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি তার শেষ বৃহৎ গ্রন্থটি শুরু করেছেন এই বলে যে ‘আওরঙ্গজেবের জীবন হলো একটি দীর্ঘ ট্রাজেডি, অদৃশ্যমান অপ্রতিরোধ্য ভাগ্যের বিরুদ্ধে এক ব্যক্তির ব্যর্থ সংগ্রামের কাহিনী, যুগের শক্তিতে কিভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী মানবীয় উদ্যোগ ব্যর্থ হতে পারে তার উপাখ্যান।’ যদুনাথ সরকারের কাছে আওরঙ্গজেব ছিলেন ট্রাজিক ব্যক্তিত্ব। অধিকন্তু, অন্যান্য উপনিবেশিক-আমলের চিন্তাবিদের মতো যদুনাথ সরকারও আওরঙ্গজেবকে মনে করতেন ধর্মান্ধ (এবং সে কারণেই ‘মোগল আল হেলাল’)। তিনি মনে করেছিলেন, ইসলামের একটি বিশেষ ধারার প্রতি তার নিবেদিতপ্রাণ থাকার কারণে সাম্রাজ্যে চরম বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছিল।
বর্তমান সময়ের খুব কম ইতিহাসবিদই যদুনাথ সরকারের মোগল সাম্রাজ্যের পতনের ধর্মভিত্তিক ব্যাখ্যাকে গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করছেন। কিন্তু তবুও সাধারণ মানুষের মধ্যে এটি লোকরঞ্জক বিষয়ই হয়ে রয়েছে। এর আংশিক কারণ, এটি আখ্যানগত সমস্যা, ঐতিহাসিক নয়। নীতিবাদী গল্পকথনে কোনো শক্তিশালী, সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের পতনের জন্য কোনো ব্যক্তিকে দায়ী করার মধ্যে মানবীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণের আবেদন রয়েছে। মুসলিম দুরাত্মারা বর্তমান সময়ে বিশেষভাবে চটকদার জিনিস, এটিই ধার্মিক আওরঙ্গজেবকে আকর্ষণীয় বলির পাঠায় পরিণত করেছে। এর বিপরীতে, আধুনিক ইতিহাসবিদেরা একগুচ্ছ সামাজিক, রাজস্ব, প্রশাসনিক কারণ উল্লেখ করেছেন, যা মোগল শক্তিকে দুর্বল করে ফেলেছিল। এ ধরনের পরিব্যাপ্ত, পদ্ধতিভিত্তিক ব্যাখ্যা ইতিহাসের জন্য উপাদেয় হলেও বাজারের গল্পকথকদের জন্য মুখরোচক নয় ।
খোলামেলাভাবে বলা যায়, আওরঙ্গজেব-পরবর্তী মোগল ভারতবর্ষ সম্পর্কে আমরা খুবই কম জানি। আমরা তার শাসনকালের সাথে সম্পর্কিত অনেক বিষয়ের ব্যাপারে এখনো অন্ধকারে রয়ে গেছি। মোগল রাষ্ট্র ফাঁপায় পরিণত করতে তার ভূমিকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলে এসব প্রাসঙ্গিক বিষয় জানা দরকার। তবে আওরঙ্গজেব দূর দৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন যে তিনি একটি তিক্ত উত্তরাধিকার রেখে যাচ্ছেন। তিনি শেষ বয়সে লেখা তার চিঠিপত্রে প্রায়ই মোগল সাম্রাজ্যের সামনে অন্ধকার দিন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যদিও সাম্রাজ্যের পতনমুখ গতি বদলে দিতে নিজেকে ক্ষমতাহীন দেখতে পেয়েছিলেন।