শেষ বছরগুলোতে আওরঙ্গজেব প্রায়ই পেছনের সময়ে ফিরলেও সামনের দিকে তাকাতেন এবং যা দেখতেন তা অপছন্দ করতেন ।
—
আওরঙ্গজেব তার সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত নিয়ে আশঙ্কায় ছিলেন। এর পেছনে যুক্তিগ্রাহ্য কারণও ছিল। মোগল সাম্রাজ্যকে চেপে ধরা আর্থিক ও প্রশাসনিক ভয়াবহ সমস্যা ছাড়াও এ ধরনের জটিলতা কাটানোর মতো সক্ষমতাসম্পন্ন কাউকে আশপাশে দেখতে পাননি তিনি ।
মৃত্যুর সময় আওঙ্গেজেবের তিন ছেলে জীবিত ছিলেন (অপর দুজন বাবার আগেই মারা গিয়েছিলেন)। এদের কাউকেই তিনি রাজা হওয়ার উপযুক্ত মনে করতেন না। উদাহরণ হিসেবে অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে মোয়াজ্জেমকে লেখা একটি চিঠির কথা বলা যায়। এতে কান্দাহার জয় করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য তার তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি তাকে তিক্ত ভাষায় গালাগাল করে বলেন, ‘অপদার্থ ছেলের চেয়ে মেয়েও অনেক ভালো।’ তিনি এরপর মোয়াজ্জেমকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘এরপর তুমি কিভাবে এই দুনিয়ায় তোমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে এবং সর্বোচ্চ পবিত্র মহামান্বিত খোদাকে মুখ দেখাবে?”
আওরঙ্গজেব বুঝতে পারেননি যে মোগল সিংহাসনে আরোহণের জন্য তার ছেলেদের দুর্বল প্রস্তুতির জন্য অনেকাংশে দায়ী তিনিই। ইতিহাসবিদ মনিস ফারুকি বিস্তারিতভাবে লিখেছেন কিভাবে আওরঙ্গজেব রাজকীয় অন্দরমহলে হস্তক্ষেপ করে মোগল রাজপুত্রদের শৃঙ্খলিত করে রেখে ছিলেন, যুবরাজদের স্বায়ত্তশাসন খর্ব করেছিলেন। ১৭০০-এর দিক থেকে আওরঙ্গজেব ছেলেদের বিপরীতে নাতিদের বেশি আনুকূল্য প্রদান করতে থাকেন, এটিও ছেলেদের অবস্থান আরো নাজুক করেছিল। অনেক সময় আওরঙ্গজেব যুবরাজদের চেয়ে অভিজাতদের অগ্রাধিকার দিতেন। যেমন ১৬৯৩ সালে জিনজিতে মারাঠা শাসক রাজারামের সাথে অবৈধ আলোচনা শুরু করার পর আওরঙ্গজেব তার সর্বকনিষ্ঠ ছেলে কাম বকশকে গ্রেফতার করার দায়মুক্তি সুযোগ দিয়েছিলেন তার প্রধান উজিড় আসাদ খান ও সামরিক কমান্ডার জুলফিকার খানকে। আওরঙ্গজেবের তাৎপর্যপূর্ণ শেষ ইচ্ছায় তিনি মোগল সাম্রাজ্যকে তিন ছেলের মধ্যে ভাগ করে দেন, আসাদ খানসহ কয়েকজনকে স্থায়িত্ব দিয়ে বিশেষ কর্মকর্তা নিয়োগ করেন ৷
মোগল যুবরাজদের প্রজন্মগুলো বিশাল নেটওয়ার্ক নির্মাণ করতেন, এটিই নতুন নতুন গ্রুপকে মোগল পতাকাতলে নিয়ে আসত, অবিভক্ত সাম্রাজ্যের মুকুটের জন্য যুবরাজদের লড়াই করতে সক্ষম করে তুলত। সংক্ষেপে বলা যায়, উত্তরাধিকার লড়াইই মোগল রাষ্ট্রকে নতুন জীবন দিত, প্রাণবন্ত করে তুলত। আওরঙ্গজেব মোগল যুবরাজদের দন্তনখরহীন করে ফেলেছিলেন। ফলে যখন সময় এলো, তখন তারা আর যুদ্ধ করতে বা শাসন করতে সক্ষম হননি ।
—
আওরঙ্গজেব তার ছেলেদের নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে কিভাবে মোগল রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতি করেছেন, সে ব্যাপারে অন্ধ থাকলেও মোগল রাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি বুঝতে পেরেছিলেন। শেষ বয়সে ছেলে ও নাতিদের কাছে লেখা চিঠিপত্রে আওরঙ্গজেব মোগল সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে তার ব্যাপক অন্তঃদৃষ্টি প্রকাশ করেছেন।
আওরঙ্গজেব ১৬৯১-পরবর্তী সময়ে আযম শাহের বড় ছেলে, তার নাতি বিদার বখতকে লেখা এক চিঠিতে কিভাবে সর্বোত্তমভাবে জীবনযাপন ও শাসন করা যায়, সে ব্যাপারে নিজের কর্মপন্থা তুলে ধরে উপদেশ দেন। তিনি শুরু করেন এই সুপারিশ দিয়ে যে পানি সামনে রেখে ফজরের নামাজ পড়তে ও কোরআন তেলায়াত করতে হবে, তারপর ওই পানি পান করতে হবে। এতে করে রোগ ও বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। বিদার বকশকে তার পরবর্তী পরামর্শ ছিল আকবরের আমল থেকে প্রচলিত একটি মোগল প্রথা অনুসরণ করার। এতে নিজেকে বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে ওজন করা হতো। আওরঙ্গজেব এটিকে হিন্দু প্রথা বিবেচনা করা সত্ত্বেও লিখেছেন, ‘যদিও সোনা, রুপা, তামা, শস্য, তেল ও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে কারো পুরো দেহের ওজন করা আমাদের পূর্বপুরুষদের দেশের বা এখানকার [ভারতবর্ষ] মুসলিমদের প্রথা নয়, কিন্তু এই ব্যবস্থার ফলে অনেক অভাবগ্রস্ত ও গরিব মানুষ বিপুলভাবে উপকৃত হয়।’ চিঠিতে সম্রাট তার নাতিকে বলেন যে শাহ জাহান বছরে দুবার নিজেকে ওজন করাতেন। তবে তিনি বিদার বকশকে পরামর্শ দেন, তিনি যেন বছরে ১৪ বার এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। আমরা দেখেছি, আওরঙ্গজেব তার শাসনকালের প্রথম দশকে নিজের ওজন করার প্রথা অনুসরণ করলেও পরে তা বাদ দেন (তবে শেষ বয়সে তিনি সম্ভবত আবার তা চালু করেছিলেন। এমন মত দিয়েছেন চ্যাপলিন জন ওভিঙ্গটন)। আওরঙ্গজেব হিন্দুভিত্তিক ওজন করা প্রথাটিকে ভারতীয় মোগল ঐতিহ্যের অংশ বিবেচনা করেছিলেন, এমনকি যদিও ব্যক্তিগতভাবে নিজে তা থেকে দূরে ছিলেন ।
একইভাবে আওরঙ্গজেব শেষ দিকে তার ছেলে আযম শাহকে লেখা এক চিঠিতে শাহ জাহানের সঙ্গীত উপভোগকে অনুমোদন করে বলেছিলেন, এটি যথার্থ রাজকাজ। উল্লেখ্য, তিনি এর কয়েক দশক আগেই এটি পরিত্যাগ করেছিলেন। মোগল বাদশাহ হওয়ার জন্য আরো অনেক পথ ছিল। শেষ বয়সের চিঠিতে আওরঙ্গজেব সমন্বয়বাদকে অনুমোদন করেছিলেন যা ছিল তার রক্তধারার অংশ, এটিই ছিল প্রবল বিরোধিতার মুখে সাম্রাজ্যের টিকে থাকা নিশ্চিতকারী বিপুল শক্তি ।
—
আওরঙ্গজেব ১৭০৭ সালের প্রথম দিকে মধ্য ভারতের আহমদনগরে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। তার ইচ্ছানুযায়ী তাকে খুলদাবাদে সুফি দরবেশ জয়নুদ্দিন শিরাজির (মৃত্যু ১৩৬৯) মাজারে অচিহ্নিত এক কবরে সমাহিত করা হয়। আপনিও এখন ওই কবর দেখতে যেতে পারেন, যদিও সেখানে ছোট, উন্মুক্ত স্থানে দেখার তেমন কিছুই নেই। হুমায়ূন, আকবর ও শাহ জাহানের জাঁকালো সমাধিসৌধের তুলনায় এই মাজারে বছরে খুব কম পর্যটকই যায় ।