—
আওরঙ্গজেবের লোকজন দোদুল্যমান হয়ে পড়লেও বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে অভিযানও বাড়াচ্ছিলেন আওরঙ্গজেব। সম্রাট তার জীবনের ৬০, ৭০ ও ৮০-এর দশকগুলো দাক্ষিণাত্যে কাটানোর পাশাপাশি প্রায়ই ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধ ও অবরোধ তদারকি করতেন। ভীমসেনের ভাষায়, খুব একটা ইতিবাচকভাবে নয়, ‘[আওরঙ্গজেব] ব্যক্তিগতভাবে কিছু পাথরের স্তূপের জন্য হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটছেন।’ আওরঙ্গজেব তার ক্রমবর্ধমান তৎপরতার মাধ্যমে সাফল্য লাভ করছিলেন, সুস্থ বা অসুস্থ থাকুন, সৈন্যদল পরিচালনার নির্দেশ দিয়েই যাচ্ছিলেন। তিনি এক প্রশাসককে লিখেছেন, ‘যতক্ষণ এই নশ্বর জীবনের একটি শ্বাসও বাকি থাকবে, ততক্ষণ শ্রম আর কাজ থেকে মুক্তি নেই।’ অফিসারেরা পছন্দ না করলেও দাক্ষিণাত্যে বাস করাটা সম্রাট নিজে উপভোগ করতেন। আগের যুবরাজ আমলে তিনি তার বাবাকে দাক্ষিণাত্যের টাটকা বাতাস, মিষ্টি পানি আর ব্যাপক চাষাবাদের প্রশংসা করে লিখেছিলেন ।
দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেবের অনেক কার্যক্রমের জন্য মানুষের জীবন ও জীবিকার দিক থেকে উচ্চ মূল্য দিতে হয়েছে। মোগল ও মারাঠা উভয়েই গ্রাম এলাকা জ্বালিয়ে দিয়েছিল, কোনো কোনো এলাকায় দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছিল । মোগল অবরোধের ফলে অনেক এলাকায় বিপুলসংখ্যক প্রাণহানি ঘটত, আবার এর পর নেমে আসত রোগ-বালাই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৯০ সালে পাঁচ বছর আগের তুলনায় বিজাপুরের জনসংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসে। এখানেও মোগল আক্রমণের পরপরই কলেরার বিস্তার ঘটে। করুণা লাভের জন্য আকুল আবেদনে সম্প্রসারণ অভিযান পরিত্যক্ত করা বা তার কৌশলে পরিবর্তন ঘটত না। অবশ্য কোনো কোনো সময় সামান্য স্বস্তির ব্যবস্থা করা হতো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভয়াবহভাবে আক্রান্ত এলাকায় তিনি কর মওকুফ করে দিতেন, খরার কারণে ১৬৮৮-৮৯ সময়কালে হায়দরাবাদের জিজিয়া বাতিল করেছিলেন, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধের ক্ষতির কারণে ১৭০৪ সালে পুরো দাক্ষিণাত্যের জিজিয়া কর থেকে রেহাই দিয়েছিলেন। মোগল ও মারাঠা সঙ্ঘাতের ফলে যে কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, এসব পদক্ষেপ তাতে সামান্যই স্বস্তি সৃষ্টি করতে পারত ৷
আওরঙ্গজেব ছিলেন সম্রাট। ফলে তার সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের জন্য বিশেষ কোনো কারণ দেখানোর প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু তারপরও বৃদ্ধ বয়সে ও অনেক মোগল কর্মকর্তার আরো যৌক্তিক বিবেচনাকে অগ্রাহ্য করে আওরঙ্গজেব কেন এ ধরনের আগ্রাসী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, সে প্রশ্ন জাগতেই পারে। সামনাসামনি যুদ্ধে মোগলদের সমকক্ষ না হওয়া সত্ত্বেও রাজকীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষিপ্র, আকস্মিক ও গেরিলা কৌশল অবলম্বন করে অনেক বেশি কার্যকারিতার পরিচয় দেওয়া মারাঠা যোদ্ধাদের অব্যাহত প্রতিরোধে কি আওরঙ্গজেব হতাশ হয়েছিলেন? আওরঙ্গজেব কি বিশ্বাস করতেন যে আরো ভূখণ্ড মোগল রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে সহায়ক হবে? কিভাবে সরে আসতে হবে, তা না জানার কারণেই কি তিনি দক্ষিণ ভারত জয়ের জন্য তার জীবনের এতটা অংশ নিবেদন করেছিলেন? কারণ যাই হোক না কেন, মনে হচ্ছে, আরো বেশি বেশি ভূখণ্ড জয়ের নেশায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন আওরঙ্গজেব ।
মৃত্যুন্মুখ রাজা
এই দুনিয়ার যন্ত্রণা তো খুবই ভয়াবহ, আর আমি স্রেফ একটা কোমল কলি–
আমি কিভাবে সূর্যঘড়িতে মরুভূমির সব বালি ঢেলে দেব?
–আওরঙ্গজেব
আওরঙ্গজেব তার শেষ বয়সের বড় একটি অংশ যুদ্ধক্ষেত্রে কাটালেও নিজের জীবন ও মোগল রাষ্ট্রের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তাভাবনা করার মতো সময় বের করতে পেরেছিলেন। সম্রাট দাক্ষিণাত্য দিয়ে পথ চলার সময় (ক্রমবর্ধমান হারে তাকে বহন করে নেওয়া হচ্ছিল, চিত্র ৭) জেনারেল, রাজকীয় কর্মকর্তা ও পরিবার সদস্যদের কাছে পত্র লিখতেন। এসব নথিপত্র তার অন্তঃদৃষ্টি ও নিজের জীবনের ব্যাপারে অনুশোচনা, ভারতবর্ষের ইতিহাসে তার স্থান, মোগল সাম্রাজ্যের বিশাল অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছে।
আওরঙ্গজেবের শেষ বয়সের কিছু উদ্বেগ ছিল দুনিয়াবি ও চরমভাবে মানবীয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তিনি বারবার তার অন্যতম প্রিয় ফল আম নিয়ে লিখেছেন। মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের আমল থেকেই মোগলরা আম ভালোবাসত। তিনি তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘আম যখন ভালো, তখন সত্যিই ভালো।’ আওরঙ্গজেব তার ছেলে ও কর্মকর্তাদের ঝুড়ি ঝুড়ি আম পাঠাতে বলতেন, তারা তা করলে তিনি তাদের প্রশংসা করতেন। আওরঙ্গজেব অপরিচিত প্রজাতির আমের নাম রাখতেন সংস্কৃত শব্দভাণ্ডার থেকে উৎপত্তি হওয়া হিন্দি শব্দে, যেমন সুধারস, রসনাবিলাস ইত্যাদি। হাতে আসা আমের চালান নষ্ট হয়ে গেলে তিনি অসন্তুষ্ট হতেন।
আওরঙ্গজেব তার যৌবনকালের কথাও স্মরণ করতেন, পরিবারের সাথে তার দিনগুলো ছিল অনেক সুখের ছিল বলে মনে করতেন। যুবরাজ আযমকে লেখা ১৭০০ সালের এক চিঠিতে তার ছেলের শৈশবের স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছেন। রাজকীয় ঢোলের শব্দ নকল করে আযম হিন্দি শব্দে বাবা সম্বোধন করে চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘বাবাজি, ধুন, ধুন।’ শেষ বয়সে আওরঙ্গজেব বিশেষভাবে উদয়পুরির (তার সবচেয়ে ছোট ছেলে কাম বকশের মা । আশ্চর্যজনক ঘটনা হলো, তিনি ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ) সঙ্গ উপভোগ করতেন। মৃত্যুশয্যায় কাম বকশকে লেখা এক চিঠিতে আওঙ্গজেব বলেন যে অসুস্থতা সময় উদয়পুরি তার সাথে আছেন এবং মৃত্যুর পর তিনিও অল্প সময়ের মধ্যে তার সঙ্গী হবেন। উদয়পুরি মারা যান ১৭০৭ সালে, আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর কয়েক মাস পর ৷