ভূখণ্ডগত সম্প্রসারণের পরিভাষায় আওরঙ্গজেব তার দাক্ষিণাত্য অভিযানে নজিরবিহীন সাফল্য লাভ করেন। উপমহাদেশের দক্ষিণাংশজুড়ে মোগল নিয়ন্ত্ৰণ সম্প্রসারণের জন্য তিনি সামরিক ও কূটনীতি উভয় সম্পদই ব্যবহার করেন । কিন্তু আওরঙ্গজেব জীবিত কালেই দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধগুলো অপ্রত্যাশিতভাবে ইঙ্গিত দিতে থাকে যে মোগল সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত ভালো নয়। আওরঙ্গজেবের শেষ দশকগুলোর নির্মম আক্রমণ ও সীমাহীন অবরোধ ছিল কৃত্রিমভাবে সাফল্যপূর্ণ, তবে চূড়ান্তভাবে ফাঁপা ।
—
দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেবের অনেক বিজয়ের মধ্যে বিজাপুর ও গোলকোন্ডা জয় ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, অবশ্য তা ছিল বেশ ব্যয়বহুলও ।
আওরঙ্গজেব ১৬৮৫ সলে বিজাপুর অবরোধ করেন। এটি ১৪৮৯ সাল থেকে আদিল শাহি রাজবংশের মাধ্যমে শাসিত হতো, তাদের সেনাবাহিনীতে সদস্য ছিল ৮০ হাজার। বিজাপুরের শাসক সিকান্দারকে তার ৩০ হাজার লোকসহ নগরীর সুরক্ষিত প্রাচীরগুলোর অভ্যন্তরে ১৫ মাস ধরে আটকে ফেলা হয়। ক্ষুধায় উভয় পক্ষের অনেক লোক মারা যায়, কিন্তু সিকান্দার আদিল শাহ আত্মসমর্পণ করার আগে পর্যন্ত মোগলরা অবরোধ প্রত্যাহার করেনি। পরাজিত শাসক ১৬৮৬ সালে আওরঙ্গজেবের কাছে এসে মোগল সার্বভৌমত্ব গ্রহণ করার ব্যাপারে তার ইঙ্গিত নিশ্চিত করতে ভূমিতে নত হন ।
কুতুব শাহি রাজবংশ নিয়ন্ত্রণ করত গোলকোন্ডা। ১৫১৮ সালের দিক এই রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের মাধ্যমে পরের বছরই মোগল বাহিনীর কাছে এর পতন ঘটে। মোগলরা প্রথমে কুতুব শাহি সেনাবাহিনীর বেশির ভাগ অংশকে গোলকোন্ডা দুর্গে তাড়িয়ে তারপর অবরোধ আরোপ করে (চিত্র ৬)। মোগল সেনাবাহিনী আট মাস ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। এ সময় তারা কুতুব শাহি বাহিনীকে খাদ্য, পানি ও শক্তিবৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত করে। এ ধরনের বঞ্চনা আর সহ্য করতে না পেরে এক কর্মকর্তা এক রাতে ফটক সামান্য খুলে চলে যাওয়ার জন্য আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে ঘুষ নেন। মোগল বাহিনী দ্রুততার সাথে তাতে প্রবেশ করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কুতুব শাহি রাজ্য গ্রহণ করে, এর বিখ্যাত হিরার খনিগুলো মোগল পতাকার অধীনে নিয়ে আসে ।
গোলকোন্ডার পর আওরঙ্গজেবের কাছে প্রধান বিরোধী হিসেবে টিকে থাকে কেবল মারাঠারা। মারাঠা নেতারা ১৬৯৮ সালে মোগলদের কাছে তামিল নাড়ুর দুর্গ জিনজি (গিনগি) খোয়ায়। ১৬৯৯ থেকে ১৭০৬ সাল পর্যন্ত আওরঙ্গজেবের বাহিনী মারাঠাদের এক ডজন দুর্গে আক্রমণ চালায়, মোগল সীমান্ত বৃদ্ধি পায়, প্রায় পুরো উপমহাদেশ তাদের হাতে চলে আসে। সামগ্রিকভাবে আওরঙ্গজেব চারটি নতুন মোগল প্রদেশ যুক্ত করেন, যা সম্মিলিতভাবে ছিল পুরো মোগল সাম্রাজ্যের এক চতুর্থাংশের চেয়ে বেশি। তবে এই মোগল দখলদারিত্ব হয়েছিল স্বল্পস্থায়ী। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর কয়েক দশকের মধ্যেই মোগলরা দাক্ষিণাত্যে তাদের সব অর্জন খুইয়ে ফেলে; সাম্রাজ্য সঙ্কুচিত হয়ে আসতে থাকে ।
—
এমনকি আওরঙ্গজেবের জীবনকালেও দাক্ষিণাত্যে সামরিক অভিযানে মোগল রাষ্ট্রের জন্য বড় বড় সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। অব্যাহত সঙ্ঘাতে কোষাগার খালি হয়ে পড়ছিল, অনেক অভিজাত সদস্যের ইচ্ছা নষ্ট হয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে রাজপুত ও উত্তর ভারতের অন্যান্য এলাকার মানুষ দক্ষিণ ভারতে দশকের পর দশক ধরে কাটাতে বিরক্ত হয়ে পড়েছিল। এলাকাটি ছিল তাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে, সেখানকার জলবায়ু, সংস্কৃতি ও জনসাধারণকে নিজের মনে করত না তারা। উদাহরণ হিসেবে উত্তর প্রদেশের কায়স্থ বর্ণের ভীমসেন স্যাক্সেনার কথা বলা যেতে পারে। তার পরিবার কয়েক প্রজন্ম ধরে মোগলদের অধীনে কাজ করেছে। তিনিও খোলামেলাভাবে সফর ও পরিবার থেকে দীর্ঘ সময় আলাদা থাকার কষ্টের কথা বলেছেন । তিনি দক্ষিণ ভারতীয়দের প্রতি তার প্রতি বিতৃষ্ণা প্রকাশ করে তাদেরকে পুরোপুরি বিদেশী লোক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ১৬৯০-এর দশকের মধ্যভাগে দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধগুলো সম্পর্কে ভীমসেন যা লিখেছেন তাতে আধুনিককালের দৃষ্টিতে বেশ আপত্তিকর মনে হবে। তিনি দক্ষিণের হিন্দুদের সম্পর্কে লিখেছেন : ‘তারা কালো বর্ণের, বাজে গড়নের ও কুৎসিত চেহারার। আগে দেখা হয়নি, এমন কারো সাথে যদি রাতের অন্ধকারে সাক্ষাত হয়, তবে সে হয়তো ভয়েই মরে যাবে।’ এ ধরনের লোকদের মুখোমুখি হওয়াকে তারা বিরক্তিকর মনে করত, অনেকে ভাবত যে মোগল চাকরি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে।
অন্য মোগল কর্মকর্তাদের কাছে অবশ্য দক্ষিণের জীবন সহ্যকর বলেই মনে হয়েছিল। তবে মোগল মনসব ব্যবস্থা নিজের ভারেই ভেঙে পড়ে ছিল। অভিজাতদেরকে আয়ের উৎস ভূমি পাওয়ার (জায়গির) জন্য প্রায়ই তাদেরকে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হতো। ইতোমধ্যেই মোগল রাষ্ট্র তার কাছ থেকে যে নির্দিষ্ট সংখ্যক সৈন্য পাওয়ার প্রত্যাশা করত, ওই সব সৈন্যের বেতনের জন্য যে সম্পদ ব্যয় করতে হতো, তা এমন অবস্থায় তাদের কাছে থাকত না। বিশ্বাসঘাতকতা করা ও দলত্যাগ ছিল সাধারণ ঘটনা ।
জিনজি অবরোধের সময়কার অস্থিরতা এমন কিছু ইঙ্গিত দিয়েছিল যা দাক্ষিণাত্যের বছরগুলোতে অনেক মোগল সৈন্য ও অভিজাতকে হঠাৎ করে অভিভূত করে ফেলেছিল। আওরঙ্গজেব ১৬৯৮ সালে জিনজি দখল করেন, তবে তা হয়েছিল আট বছর অবরোধের পর। এত দীর্ঘ অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি যুক্তিগ্রাহ্য করা কঠিন। পর্যবেক্ষকেরা এজন্য কমান্ডার জুলফিকার খানকে দায়ী করেন। তাদের মতে, এই কমান্ডার দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিশীল ছিলেন না। এ নিয়ে অনেক গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। এর একটি ছিল এই যে তিনি জিনজি নিয়ন্ত্রণকারী মারাঠাদের সাথে গোপন আঁতাত করেছিলেন । তাছাড়া তিনি হতশ্রী কান্দহার অভিযানেও যেতে না চাওয়ায় বিজয় সম্পন্ন করার কাজে সময়ক্ষেপণ করছিলেন। কারণ, এর পরই তাকে সেখানে পাঠানো হবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। যাই হোক না কেন, একটি অবরোধ অপ্রয়োজনীয়ভাবে দীর্ঘায়িত হওয়ায় মনে হচ্ছে যে সেনাবাহিনীর নৈতিক শক্তি ও রাজকীয় কর্তৃত্ব শিথিল হয়ে যাওয়া ।