আওরঙ্গজেব কেন কিছু মন্দির ধ্বংস করলেন এবং অন্যগুলো একেবারে অক্ষত রেখে দিলেন তার ব্যাখ্যা ইতিহাসের আলোকে কলি যুগ ও জিহাদ তত্ত্ব দিতে না পারলেও বিকল্প ধর্মীয় কারণও বিরাজ করতে দেখা যায়। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর ইতিহাস রচনাকারী মুস্তাইদ খান বলেছেন যে ১৬৬৯ সালে আওরঙ্গজেব জানতে পারেন যে ‘থাট্টা, মুলতান ও বেনারসের কিছু বিচ্যুৎ ব্রাহ্মণ তাদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভ্রান্ত বই পড়াচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে ভ্রষ্ট শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য দূর দূরান্ত থেকে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোকজন সেখানে যাচ্ছে।’ মাথুরার কেশব দেব মন্দিরের ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য হতে পারে। সেই জাহাঙ্গীরের আমলেও এ মন্দিরটির দিকে মুসলিমরা আকৃষ্ট হয়েছিল।
মোগল বাদশাহদের কয়েকটি প্রজন্ম নির্দিষ্ট কিছু ধর্মীয় আচরণ, বিশেষ করে মোগলদের দৃষ্টিতে অপেক্ষাকৃত কম মার্জিত হওয়ার সুযোগ গ্রহণকারী ভ্রান্ত ব্রাহ্মণদের দমন করার চেষ্টা করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আকবর নিম্নবর্ণের লোকদের কাছে হিন্দু গ্রন্থগুলোর ভুলভাবে উপস্থাপনের জন্য ব্রাহ্মণদের দায়ী করেছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে সংস্কৃত পুস্তকগুলো ফারসিতে অনুবাদ করা হলে (তার দৃষ্টিতে) এসব ঔদ্ধত্যপূর্ণ নেতা তাদের পথ সংশোধন করতে উদ্দীপ্ত হবেন ।
আওরঙ্গজেবও সাধারণ হিন্দুদের প্রতারিত করার লক্ষ্যে ব্রাহ্মণদের নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করতেন, এবং সম্ভবত বিশেষভাবে আতঙ্কিত ছিলেন এই ভেবে যে, মুসলিমরা ভণ্ড লোকদের খপ্পরে পড়ে যাচ্ছে। এ ধরনের প্রতারণার মাধ্যমে ব্রাহ্মণরা আর্থিকভাবেও লাভবান হতেন। ফরাসি পর্যটক জ্যাঁ ডি থেভেনট অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে বেনারসে ব্রাহ্মণদের সংখ্যা অনেক এবং তারা বিপুলসংখ্যক লোককে টেনে আনা বড় বড় অনুষ্ঠান থেকে ‘লাভবান হওয়ার পথ খোঁজে। এ ধরনের ক্ষেত্রে মোগল রাজকীয় বাধ্যবাধকতা ছিল তাদের প্রজাদেরকে প্রতারিত হওয়া প্রতিরোধ করার জন্য দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণ। বেনারস ও অন্যান্য স্থানের বেশির ভাগ মন্দিরে ভ্রান্ত কার্যকলাপ হয় কিনা তার অনুসন্ধান করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। তবে বিশ্বনাথ ও কেশব দেব মন্দিরের ক্ষেত্রে তার মনে হয়েছিল, ধ্বংস করাই হবে যথাযথ ।
—
আওরঙ্গজেবের লক্ষ্যবস্তু হওয়া বেশির ভাগ মন্দির ছিল উত্তর ভারতে। গুটিকতেক ব্যতিক্রম ছাড়া আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের কোনো মন্দির ধ্বংস করেননি। অথচ এখানেই তার জীবনের শেষ তিন দশক মোগল সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের কাজে তার সেনাবাহিনী নিয়োজিত ছিল। মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে অসংখ্য মন্দির ভেঙ্গে ফেলা সম্ভব ছিল। কারণ মোগলরা এসব এলাকায় তাদের সামরিক শক্তি দুর্গ ও অন্যান্য সামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলোর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছিল। কিন্তু আওরঙ্গজেব মোগল সাম্রাজ্যে নতুন নতুন এলাকা সফলভাবে একীভূত করার সাথে মন্দির ভাঙ্গাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে বিবেচনা করেননি।
এমনকি আওরঙ্গজেব যখন দক্ষিণ দিকে মোগল শাসন সম্প্রসারণের পথে ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে পড়েছিলেন, তখনো তিনি প্রয়োজনের আলোকে অন্যান্য কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে, আওরঙ্গজেব ও তার কর্মকর্তারা মনে করতেন যে মন্দির ভাঙ্গা হলো চরম পদক্ষেপ, তাই এর ব্যবহার করতে হবে খুবই কম!
৭. শেষ সময়
দাক্ষিণাত্য বিজয়
আমি এই দুনিয়ার মানুষদেরকে খুবই লোভী দেখেছি, আওরঙ্গজেব আলমগিরের মতো সম্রাট একেবারে বিনা কারণে এত ব্যাকুলতা ও আবেগ নিয়ে দুর্গ দখল করেন যে মনে হয় তিনি ব্যক্তিগতভাবে কিছু পাথরের স্তূপের জন্য হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটছেন ।
–হিন্দু সৈনিক ভীমসেন স্যাক্সেনার ফারসি স্মৃতিকথা, ১৭০৭
যদি কোনো দরবেশ অর্ধেক রুটি খান, তবে তিনি বাকিটা দেবেন কোনো গরিবকে।
রাজা কোনো পুরো ভূখণ্ড জয় করলেও তিনি আরেকটির জন্য ব্যাগ্র হয়ে ওঠেন।
–সাদি, গুলিস্তাঁ
আওরঙ্গজেব ১৬৮০-এর দশকের প্রথম দিকে দিল্লির ময়ূর সিংহাসন পেছনে ফেলে দাক্ষিণাত্যের দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি দাক্ষিণাত্যে মোগল সম্প্রসারণ অভিযানে একের পর এক কমান্ডারকে পরিচালনা করছিলেন, কিন্তু কোনো কিছুতেই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাননি। দাক্ষিণাত্যের প্রতি মোগলদের আকর্ষণ ছিল সেই আকবরের আমল থেকে, আগের শতকে তারা ওই এলাকায় অনেকগুলো সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিল। কিন্তু আওরঙ্গজেব দক্ষিণ ভারত জয় করার জন্য নজিরবিহীন সম্পদ নিয়োজিত করেছিলেন, নিজেও জীবনের শেষ দশকগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে কাটিয়েছেন ।
আওরঙ্গজেব তার সব জীবিত ছেলে (যুবরাজ আকবর ছাড়া, তিনি ছিলেন বিদ্রোহী) ও হেরেমসহ বিপুলসংখ্যক সহকর্মী নিয়ে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে গেলেন। চলমান তাঁবু শিবিরের সাথে নিশ্চিতভাবেই ভ্রাম্যমান বাজার, সেনাবাহিনী, আমলাতান্ত্রিক কর্মকর্তা ও চাকর-বাকরের দল ছিল। কয়েক মাস পথ চলার পর কাফেলা দাক্ষিণাত্যে পৌঁছে, বিজয়ের দিকে দৃষ্টি ফেললেন আওরঙ্গজেব ।
মোগল সম্রাটেরা অনেক সময়ই চলমান অবস্থায় থাকতেন, আওরঙ্গজেব সম্রাটের সাথে রাজধানী নিয়ে চলাচল করার মহান মোগল ঐতিহ্য অনুসরণ করেছিলেন। তবে আওরঙ্গজেবের পদক্ষেপে অভিনবত্ব যা ছিল তা এই যে তিনি রাজধানী স্থায়ীভাবে দক্ষিণ দিকে সরিয়ে নেন। তার অনুপস্থিতিতে ও জনসংখ্যা বেশ কমে যাওয়ায় অনেকের কাছে দিল্লি পরিণত হয় ভুতুরে নগরীতে। লাল কেল্লার কক্ষগুলো ধূলিমলিন হয়ে সফরকারী দূতদের যাওয়ার অনুপযুক্ত বিবেচিত হয় ।