উপনিবেশ-পূর্ব আমলের ভারতবর্ষে মন্দির ভাঙ্গার ব্যাপারটি ইটনের মতে, “সংখ্যার খেলায় কাটাকাটিতে মেতে ওঠা’ একটি পণ্ডশ্রম। আওরঙ্গজেব কেন সুনির্দিষ্ট কিছু হিন্দু মন্দিরকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিলেন, আর বিশালসংখ্যক মন্দিরকে স্পর্শ করার বাইরে রেখেছিলেন. তা নিয়ে যুক্তি পুনঃগঠনের জন্য আমরা আরো দৃঢ় ভিত্তির ওপর অবস্থান করছি।
—
রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের কারণেই নির্দিষ্ট হিন্দু মন্দিরগুলোর ওপর হামলা চালাতে প্ররোচিত হয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। আওরঙ্গজেব ১৬৬৯ সালে বেনারসের বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারপর ১৬৭০ সালে কেশব দেব মন্দির গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। উভয় ক্ষেত্রেই আওরঙ্গজেব মন্দিরের সাথে সম্পৃক্তদেরকে তাদের রাজনৈতিক ভুল পদক্ষেপের শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন এবং মোগল রাষ্ট্রের প্রতি তাদের ভবিষ্যতের আনুগত্য নিশ্চিত করতে চেয়েছেন ।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক কারণে ধ্বংস করার ধারণাটি আধুনিক অনেক লোকের কাছে অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত হলেও প্রাক-আধুনিক ভারতবর্ষে ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে এ ধরনের জোরালো রেখা টানা ছিল না। বরং এর বিপরীতে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ই মন্দিরকে ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক পদক্ষেপের সাথে সম্পর্কিত মনে করত। সম্ভবত ষোড়শ শতকে লিখিত সংস্কৃত গ্রন্থ বৃহতসংহিতায় সতর্ক করা হয়েছে যে ‘দৃশ্যমান কারণ ছাড়া যদি কোনো শিবলিঙ্গ, ছবি বা মন্দির ভেঙ্গে যায়, সরে যায়, ঘাম নির্গত হয়, কাঁদে, কথা বলে বা অন্য কিছু করে, তবে ওই রাজা ও তার রাজ্য ভেঙে পড়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হচ্ছে।’ ধর্মীয় প্রতিমার রাজনৈতিক শক্তি থাকার এই বক্তব্যের আলোকে হিন্দু রাজারা সপ্তম শতক থেকে একে অন্যের মন্দিরগুলো লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতেন, নিয়মিতভাবে দুর্গা, গনেশ, বিষ্ণু ইত্যাদি দেব-দেবীর মূর্তি লুটপাট করতেন, ভেঙে ফেলতেন। তারা নিয়মিতভাবে একে অপরের মন্দিরগুলো ধ্বংস করতেন। কোনো কোনো হিন্দু রাজা এ ধরনের কাজকে উদযাপন ও স্মরণে রাখার জন্য সংস্কৃত কবিতা রচনা করতেন। আওরঙ্গজেবের মতো ইন্দো-মুসলিম শাসকেরা এর আলোকে শাস্তিমূলক রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ হিসেবে হিন্দু মন্দিরগুলোকে বৈধ লক্ষ্যবস্তু বিবেচনা করতেন।
আওরঙ্গজেব ১৬৬৯ সালে বেনারসের বিশ্বনাথের মন্দিরের বড় অংশ ভেঙ্গে ফেলেন। আকবরের আমলে রাজা মানসিং মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন । অনেকে মনে করেন, মানসিংহের নাতির ছেলে জয় সিং ১৬৬৬ সালে মোগল দরবার থেকে শিবাজি ও তার ছেলে শম্ভুজিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন। এই জয় সিংই এর আগে পুরান্দারে শিবাজির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়েছিলেন । এছাড়া ১৬৬৯ সালে বিশ্বনাথ মন্দিরের সাথে সম্পর্কিত বেনারসের অনেক জমিদারদের মধ্যে একটি বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। তাদের অনেকেও শিবাজির পলায়নের সাথে জড়িত ছিলেন।
আওরঙ্গজেব ১৬৭০ সালে মাথুরার কেশব দেব মন্দিরটি নিশ্চিহ্ন করার নির্দেশ দেন। ১৬১৮ সালে বীর সিং বুন্দেলার নির্মিত এ মন্দিরটি ভাঙ্গার পেছনেও ছিল রাজনৈতিক কারণ। মাথুরার ব্রাহ্মণরা সম্ভবত ১৬৬৬ সালে শিবাজির আগ্রা থেকে চলে যেতে সহায়তা করেছিলেন। অধিকন্তু কেশব দেব মন্দিরটির পৃষ্ঠপোষকতা করতেন সিংহাসনে আওরঙ্গজেবের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দারা শুকোহ। আরো কাছাকাছি সময়ে, তথা ১৬৬৯ ও ১৬৭০ সালে ওই অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া জাট বিদ্রোহে মোগলদের ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। পরে বছরগুলোতে যোধপুর, খান্দেলা ও অন্যান্য অঞ্চলে একই কারণে মন্দির ধ্বংস করার নির্দেশ দেন আওরঙ্গজেব ।
বিশ্বনাথ ও কেশব দেব মন্দিরের উভয়স্থানেই মসজিদ নির্মিত হয়, তবে তা ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে। বিধ্বস্ত মন্দিরটির প্রাচীরের কিছু অংশ ভবনটির সাথে একীভূত করে নির্মিত জ্ঞানবাপি মসজিদটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এই পুনঃব্যবহারের কারণ সম্ভবত এটি মোগল কর্তৃত্ব বিরোধিতার ভয়ঙ্কর পরিণাম সম্পর্কে ধর্মীয় আবরণে দেওয়া একটি বিবৃতি। ব্যবহার করায় সুবিধা থাকাও সম্ভবত পুনঃব্যবহারের একটি কারণ। জ্ঞানবাপি মসজিদটি আওরঙ্গজেবের আমলে নির্মিত হলেও এর পৃষ্ঠপোষকের নাম জানা যায় না, কাঠামোটির কথাও মোগল নথিপত্রে নেই ।
মাথুরার কেশব দেবের মন্দিরের স্থানে নির্মিত মসজিদটির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন আওরঙ্গজেব। জাট বিদ্রোহের সময়কার মোগল কমান্ডার ও মাথুরার প্রধান মসজিদের পৃষ্ঠপোষক আবদুল নবি খানের মৃত্যুর ঘটনার মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। আবদুল নবির মৃত্যুর (এতে মাথুরার মসজিদগুলোর পৃষ্ঠপোষতা হ্রাস পেয়েছিল) মাত্র আট মাস পর কেশব দেব মন্দিরটি ধ্বংস করা হয়।
—
আমরা মোগল মন্দির ধ্বংস নিয়ে রাজনীতি পুনঃনির্মাণ করতে পারলেও মধ্য যুগের পর্যবেক্ষকেরা, যদি করেও থাকেন, খুব কমই কখনো কিছু স্থানে হামলার বাস্তব রাজনৈতিক যুক্তির ওপর জোর দিয়েছিলেন। অনেক হিন্দু ও জৈন চিন্তাবিদ মন্দির ধ্বংসকে কলি যুগ বা বর্তমান সময়ের আবির্ভাব হিসেবে দেখেছেন। মন্দির ধ্বংসের বর্ণনা করার সময় মুসলিম লেখকেরা সাধারণভাবে জিহাদ বা অন্য কোনো ধর্মভিত্তিক ধারণা তুলে ধরেছেন। ইসলামি প্রবণতাটির মূল সম্ভবত নিহিত রয়েছে এই ধারণায় যে ইসলামি আইনে সরকারের স্বার্থে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিসাধন অনুমোদন করে না। ফলে ইসলাম বিস্তারের যুক্তি উপস্থাপন ছিল ওই কাজের যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করা। এই যুক্তি সাংস্কৃতিকভাবে যথাযথ হলেও আওরঙ্গজেবের ভারতবর্ষে মন্দির ধ্বংসের ঐতিহাসিকভাবে ব্যাপকভিত্তিক ব্যাখ্যা দিতে পারে না।