আওরঙ্গজেব জৈন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিও একই ধরনের অনুকূল নীতি বাস্তবায়ন করেছেন। এখানেও আকবরের উদাহরণ অনুসরণ করে ১৬৫০ এর দশকের শেষ দিকে শত্রুঞ্জয়, গিরনার ও মাউন্ট আবুতে (তিনটি স্থানই ছিল জৈন তীর্থযাত্রীদের গন্তব্য) ভূমি মঞ্জুর করেন। তিনি সম্ভবত ১৬৮১ সালের আগে কোনো একসময় জৈন সন্ন্যাসী লাল বিজয়কে একটি আখড়া (পশাল) এবং ১৬৭৯ সালে একটি বিশ্রামাগার (উপাশ্রয়) মঞ্জুর করেন। ১৭০৩ সালের দিকে আওরঙ্গজেব জনৈক জৈন ধর্মীয় নেতা জিনা চন্দ্র সুরিকে হয়রানি থেকে রক্ষা করার নির্দেশ জারি করেন। এ ধরনের নির্দেশনার ফলে এই সময়কালের জৈন সাহিত্যে সম্রাটের উচ্ছ্বসিত প্রশংসার কারণ বুঝতে পারি। একটি স্থানে বলা হয়েছে, ‘আওরঙ্গজেব শাহ সাহসী ও শক্তিশালী রাজা’ (মারদানো আওর মহাবলী আওরঙ্গশাহি নারান্দা)।
—
আওরঙ্গজেব ১৬৭২ সালে হিন্দুদের দেওয়া সব ভূমি ফিরিয়ে নেওয়া ও এ ধরনের সব বন্দোবস্তু কেবল মুসলিমদের জন্য নির্ধারিত করার একটি আদেশ জারি করেন। সম্ভবত আলেমদের দাবির প্রতি এটি ছিল একটি ছাড়। এই নির্দেশ কঠোরভাবে পালন করা হলে তা হতে পারত হিন্দু ও জৈন সম্প্রদায়ের জন্য বড় ধরনের আঘাত। কিন্তু ঐতিহাসিক প্রমাণ বলে ভিন্ন কথা।
ভূমি দানের নতুন নীতি বিশেষ করে সাম্রাজ্যের দূর প্রত্যন্ত এলাকায় বাস্তবায়ন করা হয়নি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলার মোগল কর্মকর্তারা ১৬৭২ সালের নির্দেশ জারির আগে হিন্দুদেরকে যত ভূমি বন্দোবস্তু দিয়েছিলেন, পরে দিয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি। স্বতন্ত্র ঘটনাগুলোর প্রাচুর্যও ইঙ্গিত দেয় যে ভূমি ফিরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ ছিল কাগজে-কলমে, বাস্তবে নয়। উদাহরণ হিসেবে গুজরাতের কথা বলা যেতে পারে। আওরঙ্গজেবের শাসনকালের শেষ দিকে চিকিৎসকদের একটি পারসি পারিবার ১৭০২ সালের আগে পাওয়া ভূমি মঞ্জুরের নিশ্চয়তাপত্র পেয়েছিল। একইভাবে আগেই অন্যান্য অঞ্চলের যে বিপুলসংখ্যক উদাহরণ আমি উল্লেখ করেছি, তাতে ওই নীতির সীমিত বাস্তবায়নের ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রমাণের ভিত্তিতে আধুনিক অনেক ইতিহাসবিদ মনে করছেন যে ১৬৭২ সালের নির্দেশটি কার্যত সাম্রাজ্যের কোথাও বাস্তবায়িত হয়নি, পাঞ্জাবের মতো কিছু নির্দিষ্ট এলাকা ছাড়া তা ‘কাগজপত্রেই থেকে যায় ৷
আরো অনেক সময় হিন্দু মন্দিরগুলোর প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আওরঙ্গজেব। উদাহরণ হিসেবে আগেই উল্লেখ করা ১৬৫৯ সালের বেনারস নির্দেশের কথা বলা যায়। এতে আওরঙ্গজেব জানিয়েছেন, ইসলামি আইনের বিধান অনুযায়ী, ‘প্রাচীন কোনো মন্দির ভাঙ্গা যাবে না।’ তবে এতে আরো যোগ করা হয়েছে, ‘নতুন কোনো মন্দির নির্মাণ করা যাবে না।’ রিচার্ড ইটন উল্লেখ করেছেন, এটি বেনারসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল, আওরঙ্গজেবের শাসনকালে সাম্রাজ্যের অন্যত্র অসংখ্য মন্দির নির্মিত হয়েছে। কিন্তু তবুও এ নির্দেশটি ছিল আগেকার মোগল নীতির থেকে সরে যাওয়া। উল্লেখ্য, এ নীতিটি আওরঙ্গজেবের হিন্দু মন্দির রক্ষার জটিলতা (এবং সেইসাথে সীমা) প্রকাশ করে।
মন্দির ধ্বংসকারী
কোনো প্রাচীন মূর্তির মন্দির ভেঙ্গে ফেলা বৈধ নয় এবং প্রাচীন কাল থেকে প্রথা হিসেবে চালু থাকা সরোবরে প্রক্ষালন নিষিদ্ধ করাও দায়িত্ব আপনার নয় ৷
–ভবিষ্যত দিল্লির সুলতান সিকান্দার লোদির (শাসনকাল ১৪৮৯-১৫১৭) প্রতি মুফতিদের উপদেশ
মোগল সাম্রাজ্যজুড়ে থাকা লাখ লাখ মন্দিরের সবগুলো না হলেও বেশির ভাগই আওরঙ্গজেবের আমলের শেষ সময় পর্যন্ত টিকে ছিল।
আওরঙ্গজেবের নির্দেশে ঠিক কতটি মন্দির ধ্বংস বা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তা কেউ জানে না, আমরা কখনো জানতেও পারব না। আওরঙ্গজেবের শাসনকালে মন্দির ধ্বংসের নিশ্চিত সংখ্যা মাত্র এক ডজনের সামান্য কিছু বেশি বলে উল্লেখ করেছেন এ বিষয়ক শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ রিচার্ড ইটন। আর এগুলোর মধ্যে সরাসরি সম্রাটের নির্দেশে ধ্বংস করা হয়েছে আরো কম । অন্যান্য বিশেষজ্ঞ ইটনের উল্লেখ না করা আরো কয়েকটি মন্দির ধ্বংসের কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ১৬৫৯ ও ১৭০৬ সালে সোমনাথ মন্দির ধ্বংস-সংক্রান্ত দুটি নির্দেশ (দ্বিতীয় নির্দেশটির অস্তিত্ব থাকার অর্থ হচ্ছে, প্রথম নির্দেশটি বাস্তবায়িত হয়নি)। আওরঙ্গজেব নিজেও মন্দির অপবিত্রকরণ তদারকি করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৪৫ সালে তিনি জৈন বণিক শান্তিদাসের নির্মিত আহমদাবাদের চিন্তামনি পার্শ্বনাথ মন্দিরে মিরহাব (মুসলিমদের মসজিদে নামাজের নির্দেশসূচক) তোলার নির্দেশ দেন। কিন্তু এমনকি এ ধরনের ক্ষেত্রেও ইটন উদ্ধৃতি হলো, ‘প্রায় সবসময়ই প্ৰমাণ অতিরঞ্জিত, অসম্পূর্ণ ও এমনকি সাংঘর্ষিক।’ এমন প্রেক্ষাপটে বলা যায়, আমরা যতগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি, আওরঙ্গজেবের আমলে সম্ভবত তার চেয়ে বেশি মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল (হয়তো মোটে কয়েক ডজন?), কিন্তু এখানে আমরা অজ্ঞাত অতীতের ওপর টেনে দেওয়া কালো পর্দার মুখোমুখি হই ।
অবশ্য, ক্ষীণ যে কয়েকটি রশ্মি আছে, তার আলো থেকে আমরা ধরে নিতে পারি যে আওরঙ্গজেবের ভারতবর্ষে মন্দির ধ্বংস ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। উদাহরণ হিসেবে সাকি মস্তাইদ খানের মাসির-ই আলমগিরে (আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর সামান্য পরে লিখিত ফারসি ভাষায় ইতিহাসপুঞ্জি) ১৬৭০ সালে মথুরার কেশব দেব মন্দির গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশের কথা বলা যেতে পারে। এটিকে দৃশ্যত একেবারে ভিত্তিহীন বিরল ও অসম্ভব ঘটনা’ হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। সার্বিকভাবে মাসির-ই আলমগিরি হলো ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা আওরঙ্গজেবের শাসনকাল। এখানে অনেক সময় লেখকের অভিরুচি অনুযায়ী তথ্য পরিবর্তন করা হয়েছে। এই প্রবণতার মানে হলো এই যে এ গ্রন্থটি (এটি ইতিহাস নয়, বরং বাগাড়ম্বড়তার শিল্পকর্ম) থেকে উদ্ধৃতি দেওয়ার সময় চরম সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মাসির-ই আলমগিরিতে আওরঙ্গজেবের হাতে ভাঙ্গা মন্দিরের সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানোর বিষয়টি প্রমাণিত। এতে এমন সব গাল-গল্প উল্লেখ করা হয়েছে যেসব ঘটা অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত ।