—
মেবারের হিন্দু রাজপুত শাসক রানা জয় সিংয়ের কাছে ১৬৫৪ সালে পাঠানো এক রাজাদেশে (ফারসিতে নিশান) আওরঙ্গজেব মন্দির ও অন্যান্য অমুসলিম ধর্মীয় স্থাপনার প্রতি একজন ভালো রাজার আচরণ সম্পর্কে একটি রূপরেখা দিয়েছেন। এতে তিনি লিখেছেন : ‘মহান রাজারা খোদার ছায়া হওয়ায় খোদার দরবারের স্তম্ভ এসব উচ্চ মর্যাদার লোকের নজর নিবেদিত থাকে এই কাজে যাতে : বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন ধর্মের (মাজাহিব) লোকজন শান্তির ছায়াতলে বাস করতে পারে, সমৃদ্ধিতে তাদের দিন গুজরান করতে পারে, কেউ যেন অন্যদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে না পারে।’ আদব দুরস্ত ফরাসির মনোরম রীতি থেকে সরে এসে আমরা আওরঙ্গজেবের বক্তব্য হিসেবে যা পাই তা হলো : রাজারা হলো দুনিয়াতে আল্লাহর প্রতিনিধি এবং এ কারণে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব রয়েছে তাদের।
ওই একই রাজাদেশে ‘গোঁড়ামির (তাসুর) আশ্রয় নেওয়া’ সব রাজার নিন্দা করেছেন এ কারণে যে ওই শাসক ‘খোদার সমৃদ্ধ সৃষ্টিকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন এবং ঐশী ভিত্তিকে ধ্বংস করছেন।’ সিংহাসনে আসীন হলে আওরঙ্গজেব এ ধরনের অনৈপ্লামিক ব্যবস্থার দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এর বদলে নিজের ‘পূর্বসূরিদের শ্রদ্ধামূলক রীতি ও প্রতিষ্ঠিত বিধান’ অনুসরণ করে ‘চার কোণযুক্ত বসতিময় বিশ্বকে দীপ্তিময়’ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেবের দৃষ্টিতে ইসলামি শিক্ষা ও মোগল ঐতিহ্য তাকে হিন্দু মন্দির, তীর্থযাত্রীদের তীর্থস্থান ও সাধু পুরুষদের রক্ষা করতে বাধ্য করেছে।
আওরঙ্গজেব মোগল সাম্রাজ্যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা পরিচর্যা করার ব্যাপারে তার রাজকীয় প্রতিশ্রুতির প্রতি বিশ্বস্ততা থাকার জন্য ৪৯টি বছর পেয়েছিলেন এবং তিনি শুরু করেছিলেন দৃঢ়ভাবে। সম্রাট হিসেবে আওরঙ্গজেবের প্রথম দিকের একটি কাজ ছিল বেনারসের স্থানীয় মোগল কর্মকর্তাদের এই রাজকীয় নির্দেশ (ফরমান) প্রদান যে স্থানীয় মন্দিরগুলোর কার্যক্রমে যেন কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ না হয়। ১৬৫৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওরঙ্গজেব লিখেন যে তিনি জানতে পেরেছেন যে ‘কিছু লোক বিদ্বেষপরায়ণতা ও তিক্ততার কারণে বেনারস ও কাছের কয়েকটি এলাকায় সেখানকার প্রাচীন মন্দিরগুলোর দায়িত্বে থাকা একদল ব্রাহ্মণসহ হিন্দু অধিবাসীদের হয়রানি করছে।’ সম্রাট এরপর কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন : ‘ব্রাহ্মণ বা অন্য হিন্দুরা যাতে তাদের ঐতিহ্যবাহী এলাকায় অবস্থান করে সাম্রাজ্যের ধারাবাহিকতার জন্য দোয়া করতে পারে, সেজন্য তোমাকে অবশ্যই নজর রাখতে হবে সেখানে তাদেরকে কেউ যেন অন্যায়ভাবে হয়রানি করতে না পারে।’
মন্দির ও সেগুলোর তত্ত্বাবধায়কদের রক্ষার জন্য আওরঙ্গজেবের ১৬৫৯ সালের বেনারস ফরমানের শেষ অংশটি তার লেখা অনেক রাজকীয় আদেশের সাধারণ ধ্রুববাক্যে পরিণত হয়। তিনি তাতে বলেছিলেন, তাদেরকে তাদের মতো করে রাখতে হবে, যাতে মোগল সাম্রাজ্যের দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য ব্রাহ্মণরা দোয়া করতে পারে।
—
রাজ্য শাসনকালের পুরো সময়জুড়ে আওরঙ্গজেবের অবিচ্ছেদ্য নীতি ছিল হিন্দু ধর্মের প্রতিষ্ঠান ও তাদের নেতাদের কল্যাণ নিশ্চিত করা। তিনি অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ থেকে মন্দিরগুলোকে রক্ষা করার জন্য, হিন্দু সম্প্রদায়কে ভূমি মঞ্জুর করার জন্য এবং হিন্দু আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বদের বৃত্তি প্রদান করার জন্য অনেক নির্দেশ জারি করেছিলেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শাসনকালের নবম বছরে গৌহাটির উমানন্দ মন্দিরকে পূর্ববর্তী ভূমিদান ও রাজস্ব সংগ্রহের অধিকার বহাল রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করে একটি ফরমান জারি করেন। ১৬৮০ সালে তিনি নির্দেশ দেন যে বেনারসে গঙ্গার তীরে বসবাসকারী হিন্দু সন্ন্যাসী ভগবন্ত গোসাহঁকে যেন হয়রানিমুক্তভাবে থাকতে দেওয়া হয়। ১৬৮৭ সালে তিনি বেনারসের একটি ঘাটে থাকা কিছু ফাঁকা স্থান (ঘটনাক্রমে ওই জমি ছিল একটি মসজিদের কাছে) রামজীবন গোসাইঁকে দেওয়ার নির্দেশ দেন, যাতে তিনি ‘ধার্মিক ব্রাহ্মণ ও পবিত্র দরবেশদের’ জন্য ঘর তুলতে পারেন। ১৬৯১ সালে বালাজি মন্দিরকে সহায়তার লক্ষ্যে চিত্রকূটের মহন্ত বালক দাস নিবানিকে আটটি গ্রাম ও বেশ ভালো পরিমাণ করমুক্ত ভূমি মঞ্জুর করেন আওরঙ্গজেব। ১৬৮৮ সালে মধ্য ভারতের পূর্ব খানদেশে নেক ভট্টের ছেলে রং ভট্ট নামের এক ব্রাহ্মণকে তিনি করমুক্ত ভূমি মঞ্জুর করেন। তালিকাটি বেশ বড় এবং এতে এলাহাবাদ, বৃন্দাবন, বিহার ও অন্যান্য স্থানে মন্দির ও ব্যক্তিদের নাম রয়েছে।
হিন্দু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অনুকূলে মঞ্জুরি প্রদান করার পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য বহাল রাখেন আওরঙ্গজেব। এই ধারাবাহিকতা ফুটে ওঠে জঙ্গম নামের এক শৈব গ্রুপের সাথে তার আচরণে। গ্রুপটি আকবরের আমল থেকে মোগল আদেশ থেকে উপকৃত হয়ে আসছিল। আকবরই ১৫৬৪ সাল থেকে ভূমিতে তাদের আইনত অধিকার নিশ্চিত করেন। এ গ্রুপটি আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে বেশ কিছু ফরমান লাভ করেন। এসবের ভিত্তিতে তারা অন্যায়ভাবে বাজেয়াপ্ত হওয়া ভূমি ফিরে পায় (১৬৬৭), স্থানীয় মুসলিমদের বাধা থেকে সুরক্ষা প্রাপ্তি ঘটে (১৬৭২) ও অবৈধভাবে ধার্য কর ফেরত পেয়ে যায় (১৬৭৪)। এসব পদক্ষেপে নিশ্চিত হওয়া যায় যে ধার্মিক ব্যক্তিরা তাদের ধর্মীয় কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারতেন। আর তা ছিল আওরঙ্গেেজবর ন্যায়বিচার অন্তঃদৃষ্টির একটি অনুষঙ্গ ।