জীবদ্দশাতেও আওরঙ্গজেব জগতব্যাপী কল্পনামানসে ধরা পড়ে ছিলেন। ১৬৭৫ সালে ওই সময়ের ইংল্যান্ডের রাজকবি জন ড্রাইডেন বিদ্যমান মোগল সার্বভৌমত্ব নিয়ে বীরোচিত ট্রাজেডি আওরেঙ্গ-জেব লিখেছিলেন । আর ইউরোপিয়ান পর্যটকেরা ভারত সফর করেছেন ক্রমবর্ধমান হারে, তাদের অনেকেই খ্যাতিমান আওরঙ্গজেব আলমগীরের সাথে সাক্ষাত প্রার্থনা করেছেন। ব্রিটিশ, ডাচ, পর্তুগিজ ও ফরাসি বণিকেরা উপমহাদেশের পকেটগুলোতে কার্যক্রম পরিচালনা করত, মোগলদের সাথে বাণিজ্য চুক্তি করার প্রয়াস চালাত । অবশ্য মোগলদের দৃষ্টিতে ইউরোপিয়ানরা ছিল চুনো পুঁটি। পূর্বসূরিদের মতো আওরঙ্গজেবের মনেও দৃঢ় বিশ্বাস গেঁথে ছিল যে তিনি বিশ্ব ইতিহাসের বৃহত্তম সাম্রাজ্যগুলোর একটি পরিচালনা করছেন। এই সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল ৩.২ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার (আধুনিক ভারতের প্রায় সমান) এবং এর সম্পদ, সমৃদ্ধি ও ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য ছিল সম্মানের পাত্র।
গত কয়েক দশক ধরে অন্যান্য মোগল শাসক ইতিহাসবিদদের ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করলেও আওরঙ্গজেব শিকার হয়েছেন অবহেলার। এ সম্রাটের জীবনকে তুলে ধরার কাজটি, তার সম্পর্কে আমরা বিস্ময়করভাবেই কম জানি, কোনোভাবেই সহজ নয়। আওরঙ্গজেব ছিলেন জটিল শাসক। ক্ষমতা, ন্যায়বিচার, ধর্মপ্রীতি ও মোগল সাম্রাজ্যের দায়ভারসহ নানা সাঙ্ঘর্ষিক আকাঙ্ক্ষা ও উদ্দীপনার সমাবেশে গড়ে ওঠেছিল তার জীবন। যেকোনো পরিস্থিতিতেই এ ধরনের লোক হবেন দুরূহ ঐতিহাসিক বিষয়। তার সময় ও আমাদের নিজেদের সময়ের মধ্যকার সাংস্কৃতিক জ্ঞানের বিপুল পার্থক্যের বিষয়টি বিবেচনা করা হলে তা যে কত কঠিন হতে পারে, তা বোঝাই যাচ্ছে ।
বর্তমান সময়ে স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করে এমন উত্তপ্ত ও ফুটন্ত ইতিহাসও আওরঙ্গজেব। অবশ্য, আওরঙ্গজেবকে নিয়ে প্রচলিত লোকরঞ্জক ভাষ্যগুলোতে বাস্তব অস্তিত্বের চেয়ে বানোয়াট কাহিনীই রয়েছে বেশি। আওরঙ্গজেবকে ঘিরে থাকা কল্পকথার ধূম্রজাল ভেদ করতে পারলে আমরা সম্ভবত সপ্তদশ শতকের ভারতের এককভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বটিকে আবিষ্কার করতে পারব। বর্তমান ছাড়া অতীতে যাওয়ার অন্য কোনো পথ না থাকায় আমি প্রথমে আমাদের সময়ে কল্পিত আওরঙ্গজেবের দিকেই নজর ফেরাব। আমি তারপর দুইভাবে তথা তার সময়ের ফসল হিসেবে এবং যে যুগে তিনি বাস করেছিলেন ওই কালকে অবয়ব দানকারী সম্রাট হিসেবে তাকে বিশ্লেষণ করব ।
খলনায়ক আওরঙ্গজেবের কল্পকথা
তথাকথিত ‘গ্র্যান্ড মোগলদের’ শেষ ব্যক্তি আওরঙ্গজেব চেষ্টা করেছিলেন ঘড়ির কাঁটা উল্টা দিকে ঘোরাতে। তা করতে গিয়ে তিনি ঘড়িটি বন্ধ করে ফেলেন, এটি ভেঙ্গে যায় ।
–জওহেরলাল নেহরু
আওরঙ্গজেবের জন্য ২০১৫ সালটি ছিল খারাপ। প্রায় পুরো বছর ধরেই এই মোগল সম্রাটের নামে থাকা দিল্লির একটি প্রধান রাস্তার নাম বদল করা নিয়ে বিতর্ক চলে । স্থানীয় একটি শিখ গ্রুপ প্রথম বিষয়টি উত্থাপন করে। নাম বদলের যুক্তি হিসেবে বলা হয় যে আওরঙ্গজেব ছিলেন ‘ভারতের অসহিষ্ণু অমানবিক নৃশংস অপরাধের অন্যতম স্বৈরাচারী উৎপীড়নকারী শাসক।’ হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সাথে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্য সাথে সাথে এই স্রোতে যোগ দিয়ে তাদের ভাষায় দিল্লির ইতিহাসের অন্যতম বেদনাদায়ক অধ্যায়টিকে নিশ্চিহ্ন করার কিংবা অন্তত নগরীর রাস্তা থেকে এই উৎপীড়ক শাসকের নাম মুছে ফেলার আহ্বান জানান। নয়া দিল্লির কর্মকর্তারা এই দাবির কাছে নতি স্বীকার করে ২০১৫ সালের আগস্টের শেষ দিকে ভারতের একাদশ রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম সড়ক নামে নতুন নামকরণ করেন। এক সপ্তাহ পর রাতের অন্ধকারে নগরকর্মীরা চুপি চুপি রাস্তার সাইনগুলো থেকে আওরঙ্গজেবের নাম মুছে ফেলে।
অবশ্য এ ধরনের প্রয়াসের ফলে আওরঙ্গজেব সম্পর্কে সমাজ-বিস্তৃত স্মৃতিবিলোপ না ঘটে বরং জনসাধারণের মনে আবার তাকে জাগিয়ে তোলে । এর মাত্র এক মাস পর ২০১৫ সালের অক্টোবরে শিব সেনার এক এমপির একটি টেপ প্রকাশিত হয়। এতে তাকে এক সরকারি কর্মকর্তার প্রতি আওরঙ্গজেব কি আওলাদ (আওরঙ্গজেবের বংশধর) এবং আরো কিছু গালিগালাজ প্রয়োগ করতে দেখা যায়। ভারতীয় মুসলিমদের লক্ষ্য করে প্রয়োগ করা এ ধরনের বাক্য বাবর কি আওলাদ (বাবরের বংশধর) পরিভাষার প্রতিফলন ঘটায়। বিশেষ করে ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে ও ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজদের অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার আগ দিয়ে এর ব্যবহার বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাবরের স্থানে আওরঙ্গজেব হলো কেন?
—
বিভেদকারী হিন্দু জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী অত্যাচারী মুসলিম বিজয়ী হিসেবে বাবর ও আওরঙ্গজেব অনেক দিক থেকে বিনিময়যোগ্য। এই দিক থেকে আওরঙ্গজেব ভারতের অতীতের ধিক্কারজনক ঘটনাবলীর সাথে জড়িত ‘গোঁড়া মুসলিমদের’ পুরো শ্রেণির প্রতিনিধি এবং এ কারণে ভারতের বর্তমান সময়ে অনাকাঙ্ক্ষিত। আওরঙ্গজেবকে সবচেয়ে ধার্মিক মোগল বাদশাহ হিসেবে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করাটাও কাকতালীয় বিষয় নয়। এ কারণে আওরঙ্গজেব অতীত ও বর্তমান উভয় সময়ের উদ্দীপ্ত মুসলিম সমগ্রের (যারা তাদের ধার্মিকতা দিয়ে ভারতীয় সমাজে হুমকি সৃষ্টি করেছিল) আদর্শ প্রতিনিধিত্বকারী। এই তত্ত্ব অনুযায়ী ভারতীয় ও হিন্দু সংস্কৃতি একটি একক, সমতল অবস্থানে মিশে যায়, যেখানে অন্য ধর্মীয় গ্রুপগুলোর জন্য শ্বাস ফেলার অবকাশ থাকে সামান্যই ।