আওরঙ্গজেব বিচ্যুত বিবেচিত অরাজনৈতিক মুসলিম সম্প্রদায়গুলোর ওপরও চড়াও হয়েছিলেন। যুবরাজ থাকার সময় তিনি শিয়া সম্প্রদায়ের শাখা ইসমাইলি বোহরাদের লক্ষ্যবস্তু করেছিলেন। তিনি তাদের এক নেতাকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব তার পুরো রাজত্বকালে ইসমাইলি বোহরাদের হয়রানি করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তিনি তার শাসনকালের অষ্টম বছরে বোহরা মসজিদগুলোতে সুন্নিদের মতোই দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার নির্দেশ দেন। তিনি কয়েক দশক পরও রাজকীয় বাহিনীর সৈন্যরা এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের মাঝে মাঝেই গ্রেফতার করত।
—
পূর্ববর্তী মোগল শাসকদের মতো আওরঙ্গজেবও জনকল্যাণের নামে কোন কোন জিনিসের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে এবং ব্যক্তিগত অভিরুচির ব্যাপার হিসেবে কোনগুলোকে ছাড় দেওয়া হবে সে ব্যাপারে সতর্ক সীমারেখা টেনেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সঙ্গীতও ব্যক্তিগত অভিরুচির বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। সাধারণভাবে মনে করা হয়ে থাকে, আওরঙ্গজেব তার পুরো সাম্রাজ্যে সঙ্গীত নিষিদ্ধ করেছিলেন। এ ভুল ধারণাটির অপনোদন করেছেন ক্যাথেরিন স্কোফিল্ডের মতো বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু তা সত্ত্বেও লোকরঞ্জক ধারণার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। আওরঙ্গজেব তার নিজের দরবারে সামান্য কিছু ধরনের সঙ্গীত সীমিত করেছিলেন।
সম্ভবত আরো মজার ব্যাপার হলো, আওরঙ্গজেব কখনো তার আমলে অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যঙ্গমূলক কবিতা নিষিদ্ধ করেননি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শেষ বয়সে সরকারি কর্মকর্তা কামগর খানের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে জনৈক কবি আদি রসাত্মক একটি কবিতা রচনা করেছিলেন। অপমানিত কামগর খান এতে বাদশাহের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। আওরঙ্গজেব জবাবে বলেন, ‘এই কবি আমাকে নিয়েও [ব্যঙ্গ কবিতা রচনা করতে ছাড়েনি। আর এর বিপরীতে আমি তার পারিশ্রমিক বাড়িয়ে দিয়েছি, যাতে [এজন্য হলেও] আর সে এ কাজ না করে, কিন্তু এর পরও সে [ব্যঙ্গ] রচনা কমায়নি।’ আওরঙ্গজেব তখন আবেদনটি খারিজ করে কামগর খানকে উপদেশ দেন, ‘আমাদের উচিত হবে আমাদের সংবেদনশীলতা অবদমিত করে সম্প্রীতিতে বসবাস করা।’
৬. হিন্দু সম্প্রদায়ের তত্ত্বাবধায়ক
মন্দিরের রক্ষক
[ইলোরা] হলো সত্যিকারের, অতিলৌকিক শিল্পীর [অর্থাৎ খোদা] নিপুণ হাতে গড়া বিস্ময় –ইলোরার হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধ মন্দিরগুলো সম্পর্কে আওরঙ্গজেবের ভাষ্য
আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে ছিল অসংখ্য হিন্দু ও জৈন মন্দির। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি সুরক্ষা পাওয়ার দাবিদার ছিল, এবং আওরঙ্গজেব সাধারণভাবে সেগুলোর সমৃদ্ধির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। আবার মোগল দৃষ্টিকোণ থেকে ওই কল্যাণকামী ধারণা বাতিল হতে পারত যদি নির্দিষ্ট মন্দির বা সেগুলোর সাথে সম্পৃক্তরা রাজকীয় স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করত। এই নীতির আলোকে সম্রাট আওরঙ্গজেব তার পুরো শাসনকালে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া মন্দির ধ্বংস ও অবমাননা করেছেন ।
আধুনিক অনেক লোক কিছু মন্দিরের ক্ষতি করার আওরঙ্গজেবের নির্দেশগুলোকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর প্রতিহিংসার প্রতিফলন হিসেবে দেখে থাকে। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির মূলে রয়েছে উপনিবেশ আমলের গবেষণা ৷ এই গবেষণায় সময়োত্তীর্ণ হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতিকে ব্রিটিশ ভাগ করে জয় করার কৌশলের আলোকে উপস্থাপন করা হয়। বর্তমানে অনেক ওয়েবসাইটে হিন্দুদের বিরুদ্ধে আওরঙ্গজেবের ‘নৃশংসতার’ তালিকা তুলে ধরে (ভাসা ভাসা তথ্য উপস্থাপন এসব সাইটের অন্যতম বৈশিষ্ট্য) সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় ইন্ধন দিয়ে থাকে। আওরঙ্গজেব হিন্দুদের প্রতি ঘৃণা থেকে কতটি মন্দির ধ্বংস করেছিলেন, তার প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। সবচেয়ে চোখ ধাঁধানো ব্যাপার হলো, আওরঙ্গজেব তার সাম্রাজ্যে হাজার হাজার মন্দির গণনা করলেও বাস্তবে তিনি সর্বোচ্চ মাত্র গুটি কতেক মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। এই অসমঞ্জস্যতা অর্থপূর্ণ মনে হবে না যদি এই বদ্ধমূল ধারণা পোষণ করা হয় যে আওরঙ্গজেব ছিলেন ভারতকে হিন্দু উপাসনা স্থান শূন্য করার একনিষ্ঠ এজেন্ডায় পরিচালিত ব্যঙ্গচিত্র ধর্মান্ধ। তবে আওরঙ্গজেবের ঐতিহাসিকভাবে যুক্তিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে হবে, কেন তিনি যত হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন, তার চেয়ে বেশি মন্দির তিনি সুরক্ষিত রেখেছিলেন।
আওরঙ্গজেব আসলে অমুসলিম ধর্মীয় নেতা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষার ব্যবস্থা করার ইসলামি আইন অনুসরণ করেছিলেন। অষ্টম শতক থেকে ইন্দো মুসলিম শাসকেরা হিন্দুদেরকে জিম্মি তথা ইসলামি আইনে সংরক্ষিত শ্রেণি গণ্য করতেন। এর ফলে হিন্দুরা বিশেষ কিছু অধিকার ও রাষ্ট্রীয় রক্ষাকবচের অধিকারী হতো। অবশ্য, হিন্দু ও জৈন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে আওরঙ্গজেব ইসলামি আইনের সীমারেখা ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। বরং আওরঙ্গজেবের কাছে মন্দির সুরক্ষিত রাখা ও মাঝে মাঝে ধ্বংস করার কাজটি মোগল সাম্রাজ্যজুড়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার কারণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো ।
আওরঙ্গজেবের ন্যায়বিচারের ধারণার মধ্যে ধর্মীয় স্বাধীনতার নির্দিষ্ট কিছু ব্যবস্থাও ছিল। এ কারণেই তিনি হিন্দু উপাসনার বেশির ভাগ স্থানকে সুরক্ষিত রেখেছিলেন। সাধারণভাবে মোগল শাসকেরা প্রজাদেরকে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ধারণা ও প্রবণতা অনুসরণ করার জন্য বিপুল আনুকূল্য প্রদর্শন করতেন। এটি ছিল ওই আমলে অনেক ইউরোপিয়ান দেশের কঠোর বিধানের সম্পূর্ণ বিপরীত 1 ওইসব দেশে শাসকদের ধর্মই অনুসরণ করতে হতো প্রজাদের। অবশ্য, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ মোগল ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতায় চাপ সৃষ্টি করত। আর আওরঙ্গজেবও তার মনে হওয়া বিদ্রোহ বা অনৈতিক আচরণের ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর আঘাত হানতে দ্বিধা করতেন না। তবে এ ধরনের উদ্বেগ না থাকলে সব ভারতীয়ের প্রতি সমান আচরণ করার ব্যাপারে নিজের বিশ্বাসই আওরঙ্গজেবকে মন্দিরের প্রতি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দিতে উদ্বুদ্ধ করত।