মধ্য যুগের ভারতবর্ষে ধর্মীয় উৎসবগুলো প্রায়ই পরিণত হতো বিপজ্জনক বিষয়ে। উদাহরণ হিসেবে ভীমসেন স্যাক্সেনার কথা বলা যায়। তিনি মহারাষ্ট্রের ত্রিমবাকে প্রতি ১২ বছর পরপর হওয়া একটি বিশাল উৎসবের কথা বলেছেন (তিনি সম্ভবত কুম্ভ মেলার কথা উল্লেখ করেছেন)। সন্ন্যাসীদের সশস্ত্র দলগুলো এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে জড়ো হয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করত। এতে অনেকে হতাহত হতো। ভারতবর্ষ সফরকারী ফরাসি পর্যটক জ্যাঁ ডি থেভেনট বলেছেন, ১৬৬৬-৬৭ সময়কালে গোলকোন্ডায় মোহররম উদযাপন (তাতে হিন্দু ও মুসলিম উভয়ে অংশ নিত) এতই উন্মাদনাপূর্ণ হয়ে পড়েছিল যে সহিংসতা হওয়াটাই সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ১৬৬৯ সালে বুরহানপুরে মোহররম উৎসবের সময় ৫০ জন নিহত ও ১০০ জন আহত হয় । মোগল ভারতবর্ষে চুরি ও অন্যান্য অপরাধও ব্যাপকভাবে হতো ধর্মীয় উৎসবের সময়। যেমন গুজরাতের হলি উৎসবকারীদের বিশাল আগুন জ্বালানোর জন্য কাঠ চুরি করার প্রবণতা ছিল। আওরঙ্গজেব ১৬৬০-এর দশকের মাঝামাঝিতে এই প্রথা দমন করার জন্য তার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। একইসময় তিনি হলি ও দিওয়ালি উভয় উৎসবে অশ্লীল ভাষা ব্যবহারের বিরুদ্ধে নির্দেশও দিয়েছিলেন ।
আওরঙ্গজেব ধর্মীয় উৎসবগুলোতে প্রচুর মদ্য পান করে উন্মাদ হওয়া ও অবৈধ আচরণ করা হ্রাস করেছিলেন, তবে এ ধরনের উৎসব পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। বস্তুত, শাসনকালের প্রথম দিকে ইতোপূর্বে হিন্দু উৎসবগুলোর ওপর আরোপ করা কর হ্রাস করে এসব উৎসবকে উৎসাহিত করেছিলেন। বিপুলসংখ্যক উদাহরণে দেখা যায়, আওরঙ্গজেবের পুরো শাসনকালে লোকজন সার্বজনীন অবকাশ যাপনের সময়গুলোতে অংশগ্রহণ অব্যাহত রেখেছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৯০-এর দশকের শেষ দিকেও অনেক ইউরোপিয়ান পর্যটক ও হিন্দু লেখক হলি উদযাপনের কথা লিখেছেন। এমনকি আওরঙ্গজেবের নিজের সন্তানেরা পর্যন্ত অমুসলিম ধর্মীয় উৎসবগুলোতে অংশ নিত। আওরঙ্গজেব তার জীবনের শেষ দিকে লেখা এক চিঠিতে তার ছেলে মোয়াজ্জেমকে নওরোজ উৎসবে অংশগ্রহণ করার জন্য কঠোর শাস্তি দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব এই প্রাচীন প্রথাকে কিংবদন্তীপ্রতীম হিন্দু শাসক বিক্রমাদিত্যের অভিষেক উদযাপন স্মারকও মনে করতেন ।
—
নৈতিক আচরণ উন্নয়নের এজেন্ডার অংশ হিসেবে আওরঙ্গজেব চেষ্টা করেছিলেন তার প্রজাদের, বিশেষ করে মুসলিমদের মধ্যে ধর্মতাত্ত্বিক ঝোঁক গড়ে তুলতে । সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত করাবিষয়ক তার কথিত এজেন্ডা নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়ে থাকেন আওরঙ্গজেব। কিন্তু বাস্তবে আওরঙ্গজেবের সরকার কখনো হিন্দুদের বা অন্য কোনো ধর্মের লোকদের মধ্যে ব্যাপক ধর্মান্তরের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তবে কেউ কেউ ইসলাম গ্রহণ করার তাগিদ অনুভব করেছিল।
ইসলামে ধর্মান্তরের ফলে অনেকে মোগল ক্রমপরম্পরার উচ্চতর ধাপে উঠতে পারত, জিজিয়া কর আদায়কারীসহ মুসলিমদের জন্য নির্ধারিত অনেক চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হতো। অবশ্য, ধর্মান্তরের ফলে লোকজনকে আওরঙ্গজেবের অনুসন্ধানের আওতায়ও নিয়ে আসত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৯৯ সালে এক চিঠিতে দুই ব্যক্তির নিন্দা করেন এ কারণে যে তারা ‘তাদের ইসলামে ধর্মান্তর নিয়ে দম্ভ করছে এবং সম্রাটের বিরুদ্ধে কথা বলছে। আওরঙ্গজেব তাদেরকে ‘অধার্মিক লোক’ (বেদিন) হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আন্তরিকতা না থাকায় উভয়কেই কারারুদ্ধ করার আদেশ দেন তিনি |
সার্বিকভাবে আওরঙ্গজেবের ভারতবর্ষে খুব কম হিন্দুই ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। রাজদরবারে আসা নিয়মিত বুলেটিনগুলোতে অতি সামান্য সংখ্যক ধর্মান্তরের খবর আসত, অনেক সময় সম্পর্কিত ব্যক্তিদের নামও থাকত, এদেরও বেশির ভাগ ছিল নিম্ন পর্যায়ের রাষ্ট্রীয় কর্মী।
আওরঙ্গজেব অবশ্য মুসলিম প্রজাদের ব্যাপারে অনেক বেশি সক্রিয় ছিলেন। তিনি তাদের ধর্মের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছেন বেশি, বিশেষ করে আহমদ সরহিন্দির (মৃত্যু ১৬২৪) নির্বাচিত কিছু লেখার ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করেছিলেন। সরসিন্দি ছিলেন সুফি নকশবন্দি তরিকার সদস্য। তিনি তার তীব্র বিতর্কমূলক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত ছিলেন। তার ওই দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিমদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ বাড়িয়ে দিয়েছিল। সরহিন্দি জাহাঙ্গীরের রাজত্বের শেষ দিকে ইন্তিকাল করলেও তার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে শাহ জাহানের শাসনকালে। তার গ্রন্থ কোনো কোনো মাদরাসা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, অনেকে ক্রমবর্ধমান হারে তাকে মুজাহিদ (সংস্কারক), এমনকি নবি হিসেবেও বিবেচনা করতে থাকে। সমসাময়িক ইউরোপিয়ান শক্তিগুলো যেভাবে গ্রন্থরাজি সেন্সর করত, সে তুলনায় আনুষ্ঠানিক হাতিয়ারের অভাব ছিল মোগল সাম্রাজ্যে। কিন্তু আওরঙ্গজেব ১৬৮০-এর দশকে সরহিন্দিকে আলাদা করে রাখেন, তার কিছু ধর্মতাত্ত্বিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ রচনা নিষিদ্ধ করেন।
অনেক সময় আওরঙ্গজেব নির্দিষ্ট কিছু মুসলিম গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। এসব গ্রুপের মতবাদ ইসলাম সম্পর্কে তার ভাষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৪০-এর দশকে আওরঙ্গজেব তখনো ছিলেন গুজরাত পরিচালনার দায়িত্বে থাকা যুবরাজ, আহমদাবাদের মোগল সৈন্যরা মাহদাবি সম্প্রদায়ের (সহস্রাব্দবাদী এই সম্প্রদায় পনের শতকের শেষ দিকে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হয়) কয়েক ডজন সদস্যকে হত্যা করে। মাহদাবিদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল। সম্ভবত এ কারণেও তাদের প্রতি এ ধরনের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। এর ৪০ বছর পর, তখন তারা তাদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলেছে, মাহদাবিদের একটি প্রতিনিধিদল রাজদরবারে আওরঙ্গজেব ও প্রধান কাজিকে বোঝাতে সক্ষম হন যে তারা নিরীহ, মূলধারার মুসলিম!