আওরঙ্গজেবের বিশাল আমলাতন্ত্রে হিন্দুরা ভালো অবস্থায় ছিল, তারা চাকরি ও পদোন্নতির সুযোগ পেয়েছিল। আকবরের আমল থেকে রাজপুত ও অন্য হিন্দুরা মোগল প্রশাসনের পূর্ণ সদস্য হয়ে পড়েছিল। তারা তাদের মুসলিম প্রতিপক্ষদের মতো মনসব নামে পরিচিত আনুষ্ঠানিক পদবি (এটিই ছিল রাজকীয় পদপরম্পরায় তাদের মর্যাদা) পেত। তারা সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের জন্য লড়াই করত। মোগল অভিজাতদের মধ্যে মুসলিমেরা সংখ্যায় বেশি হলেও হিন্দুরাও মর্যাদাসূচক অবস্থায় এগিয়ে আসছিল, তারাও অতি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করত। আওরঙ্গজেবও মোগল আমলাতন্ত্রে হিন্দুদের একীভূত করার জন্য বাস্তববাদী কৌশল গ্রহণ করেছিলেন, বিশেষ করে দাক্ষিণাত্যে অভিযান চালানোর সময় তিনি হৃদয়, মন ও ভূখণ্ড জয় করতে চেয়েছিলেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে তিনি তার রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের ধর্মের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন। তিনি তাদের প্রশাসনিক দক্ষতার দিকেই নজর দিতেন।
শাহ জাহানের ছেলেদের উত্তরাধিকার যুদ্ধের (১৬৫৭-৫৯) সময় মোগল প্রশাসনের হিন্দু সদস্যদের সমর্থন আওরঙ্গজেব বনাম দারার প্রতি সমর্থনে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। রাজপুতদের বেশির ভাগ সমর্থন করেছিল দারাকে, আর মারাঠারা (মধ্য সপ্তদশ শতক থেকে তারা পরাক্রান্ত হয়ে ওঠেছিল) সমর্থন দিচ্ছিল আওরঙ্গজেবকে। তবে সার্বিকভাবে ২১ জন উচ্চ পদস্থ হিন্দু অভিজাত (অর্থাৎ যারা এক হাজার বা তার চেয়ে বেশি মনসবধারী ছিলেন) আওরঙ্গজেবের পক্ষে লড়াই করেছেন, আর ২৪ জন ছিলেন দারার সমর্থক। অন্য কথায় বলা যায়, আওরঙ্গজেব ও দারার শুকোহ প্রায় সমান হারে হিন্দু অভিজাতদের সমর্থন পেয়েছিলেন ।
হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে মোগল অভিজাতদের অনেক সদস্যের দৃষ্টিকোণ থেকে সিংহাসনে আরোহণের ক্ষেত্রে আওরঙ্গজেব ছিলেন চৌকষ বাজি। কবি চন্দর ভান ব্রাহ্মণের মতো মোগল দরবারের অন্যান্য হিন্দু সদস্যের কাছে আওরঙ্গজেবের বিজয় ছিল গ্রহণযোগ্য ঘটনা, কারণ এতে মোগল রাষ্ট্রের মূলনীতি বদলায়নি ।
প্রত্যাশা মতো, আওরঙ্গজেবের সিংহাসনে আরোহণের সূচনায় মোগল প্রশাসনে হিন্দুদের অংশে সামান্যই পরিবর্তন হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আকবরের আমলে সব মোগল অভিজাতের মধ্যে হিন্দুরা ছিল ২২.৫ ভাগ। শাহ জাহানের আমলে ও আওরঙ্গজেবের শাসনকালের প্রথম ২১ বছর শাসনকালে (১৬৫৮-৭৯) তা ২১.৬ ভাগেই থাকে। তবে ১৬৭৯ থেকে ১৭০৭ সময়কালে আওরঙ্গজেব মোগলদের অভিজাত পর্যায়ে হিন্দু অংশগ্রহণ বাড়িয়ে প্রায় ৫০ ভাগ করেন। মোগল অভিজাতের মধ্যে হিন্দু বাড়ে ৩১.৬ ভাগ । দাক্ষিণাত্যজুড়ে সম্প্রসারণশীল মোগল সার্বভৌমত্বের কৌশলগত বিষয় হিসেবে এই নাটকীয় বৃদ্ধি মারাঠাদের ব্যাপক অন্তঃপ্রবাহকে ফুটিয়ে তুলেছে।
সংখ্যা ছাড়াও রাজা রঘুনাথের কাহিনীর মতো স্বতন্ত্র ঘটনাগুলোও আওরঙ্গজেবের ভারতবর্ষে মূল্যবান হিন্দু অভিজাতদের কথা ধরে রেখেছে।
—
রাজা রঘুনাথ মাত্র পাঁচ বছর সম্রাটের সেবা করেছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন আওরঙ্গজেবের সবচেয়ে প্রিয়ভাজন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা। শাহ জাহানের আমলে অর্থমন্ত্রী হিসেবে রাজকীয় ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন রঘুনাথ। সমুগড়ে দারা শুকোহকে আওরঙ্গজেব পর্যুদস্থ করার পর একদল প্রশাসকের সাথে রঘুনাথও আওরঙ্গজেবের আনুগত্য স্বীকার করেন। রঘুনাথকে আওরঙ্গজেব তার দিওয়ান (সাম্রাজ্যের মুখ্য অর্থমন্ত্রী) হিসেবে নিয়োগ করেন। এই উচ্চ মর্যাদা এক শ’ বছর আগে সম্রাট আকবরের মুখ্য অর্থমন্ত্রী হিসেবে টোডর মলকে নিয়োগ করার কথাই মনে করিয়ে দেয়। আওরঙ্গজেব তার দ্বিতীয় অভিষেকের সময় তার হিন্দু দিওয়ানকে রাজা পদবি প্রদান করেন, মনসব আড়াই হাজার করার মাধ্যমে তাকে সম্মানিত করা হয়। তারপর থেকে রঘুনাথ দক্ষ হাতে সাম্রাজ্যের কোষাগার পরিচালনা করেন ।
কয়েক বছরের মধ্যে দরবারে রঘুনাথের প্রভাব এমনকি তার দফতরের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ার তাকে সাম্রাজ্যের ভারপ্রাপ্ত উজিড় হিসেবে অভিহিত করেছেন। চন্দর ভান এই মূল্যায়নের সাথে একমত পোষণ করেছেন, প্রশংসা করে রঘুনাথকে ‘হিন্দুস্তানের জ্ঞানী লোকবিষয়ক গ্রন্থের প্রচ্ছদপট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। রঘুনাথের জীবনের অবসান ঘটে ১৬৬৩ সালে। তিনি তখন মোগলদের প্রিয় অবকাশ যাপন কেন্দ্র কাশ্মিরের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করছিলেন আওরঙ্গজেবের সঙ্গী হয়ে । অবশ্য আওরঙ্গজেব তার প্রিয় হিন্দু দিওয়ানকে ভোলেননি ।
এমনকি কয়েক দশক পর বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুর সময়ও আওরঙ্গজেব তার কথা মনে করেছেন, তার প্রথম অর্থ কর্মকর্তার প্রতি স্মৃতিকাতরতা প্রকাশ করেছেন । শেষ বয়সে অন্যান্য প্রশাসকের কাছে লিখা চিঠিতে দক্ষ সরকার পরিচালনায় রঘুনাথের উপদেশমালার উদ্ধৃতি দিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উজিড় আসাদ খানকে লেখা চিঠিতে রঘুনাথের প্রাজ্ঞ বাণী উল্লেখ করেছেন আওরঙ্গজেব : সরকারি কাজের দায়িত্ব কোনো লোভী লোকের কাছে নয়, বরং খুবই অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও কর্মদক্ষ লোকের ওপর ন্যস্ত করা উচিত।’ মৃত্যুর ৪০ বছর পরও রঘুনাথ তার পৃষ্ঠপোষকের মনে বিশাল আকারে বিরাজ করছিলেন, এবং তা কেবল আর্থিক বিষয়েই নয়, বরং সাধারণভাবে মোগল রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি ও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রেও। মোগল সাম্রাজ্যের মহান কর্মকর্তা হিসেবে সজীব স্মৃতির কাছে রঘুনাথের ধর্মীয় পরিচিতি আওরঙ্গজেবের কাছে ছিল অপ্রাসঙ্গিক ।