আগেই বলা হয়েছে, রাঠোর-সিসোদিয়া যৌথ বিদ্রোহ দমন করার জন্য ছেলে যুবরাজ আকবরকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। আকবর এতে সফল হন। কিন্তু রাঠোর ও সিসোদিয়াদের কাছ থেকে প্রকাশ্য সমর্থন লাভ করে সুযোগ পেয়েছেন মনে করে তিনি ১৬৮১ সালের জানুয়ারির প্রথম দিকে রাজস্থানের নাদোলে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেন। রাজকীয় চাপে যুবরাজ আকবর বিদ্রোহ আরো দক্ষিণে নিয়ে যান। এদিকে আওরঙ্গজেবের আরেক ছেলে আযম শাহ ১৬৮১ সালের জুনে রাজপুতদের সাথে কূটনৈতিক নিষ্পত্তির জন্য আলোচনা করেন। এর ফলে ১৬৮১ সালের জুন মাসে রাজসমুদ্র নামে একটি চুক্তি হয়। এটি চুক্তি মেবার ও মোগল সাম্রাজ্যের মধ্যে এটা স্থায়ী ও ফলপ্রসূ শান্তির পথ দেখায়। তবে মারওয়ারে কয়েক বছর ধরে বিদ্রোহ দেখা যায়। এর কারণ ছিল প্রত্যক্ষ রাজকীয় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে হতাশা ।
এই পুরো ঘটনাকে আধুনিক ইতিহাসবিদেরা ‘রাজপুত বিদ্রোহ’ এবং মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দু বৈরিতা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এই সাম্প্রদায়িক পাঠ ভুল প্রমাণিত হয় রাঠোর ও সিসোদিয়া উভয়ের মুসলিম যুবরাজ আকবরকে সমর্থন করার সিদ্ধান্তে, রাজসমুদ্র চুক্তির ব্যাপারে তাদের ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার কথা না-ই বা উল্লেখ করা হলো। মেবার আওরঙ্গজেবের সাথে চুক্তিটি গ্রহণ করেছিল, আর মারওয়ার অব্যাহতভাবে মোগল জোয়াল থেকে মুক্তি পাওয়ার সংগ্রাম করেছে। এই ঘটনা আসলে একটি ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, কয়েক শ’ বছর ধরে মোগল শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দু ও মুসলিমেরা আরো যেসব বিদ্রোহ করেছিল সেগুলোর মতোই ।
—
আওরঙ্গজেব রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার হুমকি নিরসনে সবসময় কূটনীতির আশ্রয় গ্রহণ করতেন না। আর যেসব ব্যক্তি সম্রাটকে চ্যালেঞ্জ করতেন, তারা প্রায়ই নিজেদেরকে তার সহিংসতার সামর্থ্য এবং এমনকি অনেক সময় নৃশংসতার শিকার হতে দেখতে পেতেন ।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কয়েক বছর যুদ্ধের পর ১৬৮৯ সালে মোগল বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের পর বন্দী হিসেবে আনা শিবাজির ছেলে শম্ভূজি কোনো ধরনের করুণা লাভ করেননি। শম্ভুজি ও তার ব্রাহ্মণ উপদেষ্টা কবি কলাশকে প্রকাশ্যে অপদস্থ করার জন্য তাদেরকে ভাঁড়ের টুপি পরতে বাধ্য করতে এবং উটে করে দরবারে নিয়ে আসতে আদেশ দেন আওরঙ্গজেব । তারপর তিনি কাঁটা দিয়ে শম্ভুজির চোখ দুটি উপড়ে ফেলতে বলেন। এক ইতিহাসবিদ কাব্যে বিষয়টি বর্ণনা করেছেন, ‘তার কাঁধ আর তার মাথাটির ভার বহন করতে পারছিল না।’ কোনো কোনো ইতিহাসে বলা হয়েছে যে শম্ভুজি ও কবি কলাশের লাশ কুকুরদের সামনে নিক্ষেপ করা হয়, আর তাদের মাথা খড়ে ভর্তি করে দাক্ষিণাত্যের নগরীগুলোতে ঘুরিয়ে অবশেষে দিল্লির কোনো একটি ফটকে ঝুলিয়ে রাখা হয় ।
তবে আদর্শ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে কিছু ধরনের নৃশংসতাসহ সহিংস পন্থা অবলম্বনের দিক থেকে ওই সময় আওরঙ্গজেব প্রথাবিরুদ্ধ ছিলেন, এমন নয়। আওরঙ্গজেবের কাছে সহিংসতা কেবল অনুমোদনযোগ্যই ছিল না, তা প্রয়োজনীয় ছিল এবং তা যদি মোগল সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতা উৎসাহিত করে থাকে, তবে তা যৌক্তিকও ছিল। অবশ্য রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগের দিক থেকে ওই সময়ের মানুষ হিসেবে আওরঙ্গজেব তার ভূমিকা পালন করেছেন, এই যুক্তি তাকে পরবর্তী প্রজন্মগুলোর তীব্র সমালোচনা থেকে রক্ষা করতে পারেনি। আওরঙ্গজেবের সহিংসতার একটি একটি মর্মভেদী উদাহরণ হলো নবম শিখ নেতা তেগ বাহাদুর। বর্তমান সময়ের অনেক অস্বস্তির সাথে এ ঘটনাটি সম্পর্কিত।
পাঞ্জাবে উত্তেজনা সৃষ্টির কারণে মোগল সাম্রাজ্য ১৬৭৫ সালে তেগ বাহাদুরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। অনেক শিখ তাদের ধর্মের আদি সময়টিকে কিভাবে বিবেচনা করে, এই ঘটনা তার অন্যতম বিষয়। অথচ মোগল দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ছিল স্রেফ একটি গতানুগতিক কাজ। আওরঙ্গজেবের আমলের কোনো ফারসি গ্রন্থে এই মৃত্যুদণ্ডের উল্লেখ নেই। এতে মনে হয়, মোগলদের কাছে এটিকে বিশেষ কোনো ঘটনা বিবেচিত হয়নি। পরবর্তীকালের ফারসি সূত্রগুলো নানা সাংঘর্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এমনকি কোথায় তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল, তা নিয়েও পরস্পরবিরোধী তথ্য উপস্থাপন করা হয় । মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার স্থান হিসেবে কেউ দাক্ষিণাত্য, কেউ লাহোরের কথা বলেছেন । আর শিখ দলিল-দস্তাবেজে দিল্লিতে হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল বলে বলা হয়ে থাকে। শিখ নথিপত্রে অনেক পরের এবং সেগুলোতেও ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায় । আধুনিক পাঠ্যপুস্তকগুলোতে বারবার উল্লেখ করা লোকরঞ্জক কাহিনীতে বলা হয় যে তেগ বাহাদুর কাশ্মিরি ব্রাহ্মণদের বাধ্যতামূলক ধর্মান্তরের প্রতিবাদ করছিলেন। অথচ মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে আদিতম নথি-পত্রে এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলে না ।
বিষয়টি অনেকটাই পরিষ্কার হয় ফারসি ও শিখ উভয় সূত্রগুলোতে : আওঙ্গেজেবের দৃষ্টিতে তেগ বাহাদুর মোগল রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বিরোধিতা করেছিলেন সামরিকভাবে এবং এর ফলে তার মৃত্যুদণ্ড ছিল যৌক্তিক পদক্ষেপ । তার ধর্মীয় মর্যাদা রাষ্ট্রের শত্রুদের মৃত্যুদণ্ডসহ শাস্তি প্রদান করার ব্যাপারে আওরঙ্গজেব প্রশাসনের সর্বব্যপ্ত প্রতিশ্রুতি লঘু করতে কিছুই করেনি। আর তেগ বাহাদুরের ভাইয়ের ছেলে ও সপ্তম শিখ গুরু হর রাইয়ের উত্তরাধিকার লড়াইয়ে দারা শুকোহর প্রতি সমর্থন দিয়েছিলেন বলে যে গুঞ্জন রয়েছে, তাও এতে সহায়ক হয়নি। একই সময় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেওয়া অন্যান্য ধর্মীয় গ্রুপের (যেমন সাতনামি) প্রতিও একই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল।
মূল্যবান হিন্দু অভিজাত
হে সম্রাট দুনিয়া আপনার হুকুমে চলুক;
শুকরিয়া আর সালাম ঝরুক ঠোঁট থেকে;
আপনার আত্মা যেহেতু সব মানুষকে রক্ষা করছে,
তাই আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, ঈশ্বর আপনাকে রক্ষা করুন!
-–চন্দর ভান ব্রাহ্মণ, আওঙ্গজেবের অধীনে কর্মরত এই হিন্দু কবির রচনার মাধ্যম ছিল ফারসি