আওরঙ্গজেবকে মিশ্র মানসম্পন্ন তার রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতেও হিমশিম খেয়েছিলেন। মোগল প্রশাসকেরা নিয়মিত ঘুষ নিতেন, আওরঙ্গজেব যদিও এ ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনকি অষ্টাদশ শতকের একটি ইন্দো-ফারসি গ্রন্থের ভাষ্যানুযায়ী খাবলে ধরা ও টেনে আনার জন্য প্রধান কাজি (এই সুবাদে তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যের নৈতিক নির্দেশনাদাতা) আবদুল ওয়াহাবের ‘হাতটি ছিল দীর্ঘ, তিনি বিপুল অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন।’ দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসকেরা আওরঙ্গজেবকে হতাশ করেছিলেন, বাদশাহ তাদের অন্যায় পন্থার সমালোচনা করতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নাতি বিদার বখতকে লেখা এক চিঠিতে কয়েকজন দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাত ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে তাকে উপদেশ দেন : “শান্তি অনুপস্থিতি থাকলে সার্বভৌমত্ব থাকতে পারে না।’ তবে সম্রাট তার লোকদের প্রতি ক্ষমশীলতাও প্রদর্শন করতেন। তিনি রাজকীয় কর্মকর্তাদের কঠোরভাবে তিরস্কার করার জন্য তার ছেলেদের ধমক দিতেন, এবং অনেক সময় শাস্তি পরিবর্তন করে দিতেন ।
—
আওরঙ্গজেবের ক্ষমতাশীলতা অনেক সময়ই তার পরিবার সদস্যের প্রতি সম্প্রসারিত হতো না। রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বিরোধিতাকারীদের তিনি শাস্তি দিতেন, এমনকি স্রেফ ভুল করলেও নিস্তার মিলত না। উত্তরাধিকার লড়াইয়ের সময় এই বিষাদময় প্রবণতা ব্যাপকভাবে দেখা গেছে, তবে তার পুরো আমলে তা অব্যাহত থাকে ।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মামা শায়েস্তা খানকে আওরঙ্গজেব দক্ষিণে পাঠিয়েছিলেন ১৬৫৯ সালে শিবাজির সামরিক বিরোধিতা প্রতিরোধ করতে। শিবাজি তখন দাক্ষিণাত্যে মোগল স্বার্থের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছিলেন। শায়েস্তা খান পুনেতে সুন্দর সুন্দর ভবন ও উদ্যান নির্মাণ করেছিলেন, পুরো অঞ্চলের সমৃদ্ধি নিয়ে এসেছিলেন। খাদ্যের দাম কম থাকে, শায়েস্তা খানের বদান্যতায় লোকজন উপকৃত হয়। পুনেতে শায়েস্তা খানও আয়েসী ও বিলাসী জীবনযাপন করছিলেন, মেয়ের বাগদানের মতো অনুষ্ঠান আয়োজন করছিলেন। কিন্তু এসব করতে গিয়ে তিনি তার প্রধান লক্ষ্য তথা শিবাজিকে দমন করার গুরুত্বপূর্ণ কাজটির কথাই ভুলে গিয়েছিলেন।
শিবাজি কিন্তু শায়েস্তা খানকে ভোলেননি। তিনি ১৬৬৩ সালের বসন্তে তার প্রাসাদে গুপ্তহামলা চালান। মাত্র কয়েক ডজন লোক নিয়ে রাতের অন্ধকারে শিবাজি চুপি চুপি প্রাসাদে ঢুকে পড়েন। মারাঠারা হঠাৎ করে শায়েস্তা খানের শয়নকক্ষে প্রবেশ করে। তিনি নিজেকে রক্ষা করতে পারলেও তার একটি আঙুল কাটা পড়ে। তিনি তার পরিবারকেও রক্ষা করতে পারেননি। তার কয়েকজন স্ত্রী শেষ হয়ে যায়। শিবাজি ও তার লোকজন চলে আসার আগে শায়েস্তা খানের ছেলেকে হত্যা করেন বলে অনেক সূত্র জানিয়েছে। তারা তাকেই শায়েস্তা খান মনে করে তার বিছানায় তাকে হত্যা করে। এই লজ্জাজনক পরাজয়ের কথা শুনে আওরঙ্গজেব তার মামাকে মোগল সাম্রাজ্যের শাস্তিমূলক বদলির স্থান হিসেবে পরিচিত বাঙলায় পাঠিয়ে দেন। এমনকি তাকে পূর্ব দিকে গমনপথে ভাগ্নের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতকারের সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।
কয়েক দশক পর আরো কম নাটকীয় তবে বর্ণাঢ্য ঘটনায় আওরঙ্গজেব তার ছেলে আযম শাহকে তিরষ্কার করেন সুরাত মহাসড়কে ডাকাতি বন্ধ করতে ব্যর্থতার কারণে। আযম শাহ প্রতিবাদ করে বলেন যে এলাকাটি তার নয়, বরং অন্য এক কর্মকর্তার আওতাধীন। জবাবে আওরঙ্গজেব তার ছেলের মনসব মর্যাদা হ্রাস করে উল্লেখ করেন, ‘যদি কোনো যুবরাজের বদলে অন্য কোনো কর্মকর্তার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকত বিষয়টি, তবে তদন্তের পর এই নির্দেশ জারি করা হতো। যুবরাজের জন্য তদন্ত ছাড়াই শাস্তি।’
আওরঙ্গজেব তার চতুর্থ ছেলে যুবরাজ আকবরের বিদ্রোহের সময় আরো কঠোর হয়েছিলেন। ১৬৮১ সালে রাজস্থানে রাঠোর ও সিসোদিয়াদের বিদ্রোহ দমন করার জন্য পাঠানোর পর আকবর বিদ্রোহ করে নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা করেন। তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই তার রাজপুত মিত্রদের সমর্থন হারিয়ে শিবাজির ছেলে ও ওই পর্যায়ে আওরঙ্গজেবের চরম শত্রু শম্ভুজির দরবারে পালিয়ে যান। কয়েক বছর পর ১৬৮৭ সালে আওরঙ্গজেব তার ছেলেকে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করেন। যুবরাজ আকবর পারস্যে আত্মগোপন করেন, সেখানেই ১৭০৪ সালে ইন্তিকাল করেন ।
—
আওরঙ্গজেব তার সাম্রাজ্যে রাজপুত শাসকদের মতো আরো কিছু বিদ্রোহের মুখে পড়েছিলেন। রাজপুতেরা দীর্ঘ সময় মোগলদের অধীনে কাজ করেছিল, তবে আকবরের আমলে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় প্রথম একীভূত হওয়ার পর থেকে বিদ্রোহ করা যেন প্রথাই হয়ে পড়েছিল।
আওরঙ্গজেবের আমলে একটি অবাক করা ঘটনা ছিল ১৬৭৯-৮১ সময়কালে মারওয়ার ও মেবারের রাজপুত পরিবারগুলোর বিদ্রোহ। এ ঘটনাটি দুই রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল দেখা দেয়। ১৬৭৮ সালের ডিসেম্বরে যশোবন্ত সিং রাঠোর মারা গেলে ঝামেলার সূত্রপাত ঘটে। ওই সময় আওরঙ্গজেব দক্ষিণ পশ্চিম রাজস্থানের রাঠোর রাজ্যের উত্তরাধিকারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেন। আওরঙ্গজেবের হস্তক্ষেপকে রাঠোরের রাজপরিবার, বিশেষ করে মারওয়ারের দুই নাবালক রাজপুত্রকে সাম্রাজ্যের দরবারে লালন-পালন করা নিয়ে তার পরামর্শ ও যোধপুর দখল করার জন্য তার সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্তকে ভালোভাবে নেয়নি। প্রতিবেশী মেবারের সিসোদিয়া রাজপুতদের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি হয় যে একই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে তাদের বেলাতেও। তারা তখন মারওয়ারের সাথে জোট গঠন করে।