মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৭০৭ সালে ৮৮ বছরের পরিণত বয়সে যখন জীবনের পেছন দিকে তাকিয়েছিলেন, তখন তিনি ব্যর্থতাই দেখতে পেয়েছিলেন।
মৃত্যুশয্যা থেকে আওরঙ্গজেব ছেলেদের কাছে বেশ কিছু মর্মভেদী চিঠি লিখেছিলেন। এসব লেখায় তার অধার্মিকতার জন্য আল্লাহ তাকে শাস্তি দিতে পারেন, এমনসহ নানা ভয়ানক শঙ্কা প্রতিফলিত হয়েছে। তবে সর্বোপরি, বাদশাহ হিসেবে তার ভুলগুলো নিয়ে আর্তনাদই করেছেন বেশি। সবচেয়ে ছোট ছেলে কাম বকশের কাছে লেখা চিঠিতে তার মৃত্যুর পর অফিসার ও সেনাবাহিনীর প্রতি খারাপ আচরণ করা হবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তৃতীয় ছেলে আযম শাহের কাছে অনেক গভীর সংশয়ের কথা স্বীকার করেছিলেন : ‘শাসন করা ও জনগণকে রক্ষার গুণ আমার মধ্যে একেবারেই ছিল না। আমার মূল্যবান জীবনটা বৃথাই গেল। খোদা এখানেই আছেন, কিন্তু আমার নিষ্প্রভ চোখ তার উজ্জ্বল দীপ্ত দেখতে পারছে না।’
আওরঙ্গজেব ১৫ কোটির বেশি লোকের ওপর ৪৯ বছর শাসনকাজ পরিচালনা করেছেন। তিনি মোগল সাম্রাজ্যকে সর্বোচ্চ সীমায় সম্প্রসারিত করেছিলেন, মানব ইতিহাসে তিনিই প্রথমবারের মতো ভারতীয় উপমহাদেশের বেশির ভাগ এলাকাকে একটি একক রাজকীয় শাসনের অধীনে এনেছিলেন। আইনগত বিধিবিধানের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগে তিনি স্থায়ী অবদান রেখে গেছেন, সব ধরনের লোক ও ধর্মীয় গ্রুপের সদস্য তার কাছে ন্যায়বিচার পেয়েছে বলে তার সুখ্যাতি রয়েছে। খুবই সম্ভব যে তিনি ছিলেন তার আমলের সবচেয়ে ধনী লোক, তার কোষাগার ছিল পরিপূর্ণ। তাতে ছিল উপচে পড়া হীরা, মানিক, মুক্তা, স্বর্ণ। এমনকি জৌলুষপূর্ণ কোহিনূর হীরাও ছিল তার কাছে। তবে এসব অর্জনও শেষ দিনগুলোতে নিজের রাজনৈতিক অসম্পূর্ণতা সম্পর্কে তার উৎকণ্ঠা প্রশমিত করতে পারেনি ।
আযম শাহ ও কাম বকশ- উভয়ের কাছে আওরঙ্গজেব তার ধর্মীয় ত্রুটিগুলোর কথাও স্বীকার করে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে তাকে শিগগিরই কঠিন ঐশী বিচারের মুখে পড়তে হতে পারে। নিবেদিতপ্রাণ মুসলিম হিসেবে চিন্তা করেছেন যে এই জীবন ও পরকালে তিনি ‘আল্লাহর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথই বেছে নিয়েছিলেন।’ তিনি বোঝাহীনভাবে এই দুনিয়ায় এলেও পাপের বোঝা নিয়ে পরকালে যাচ্ছেন বলে ধারণা তার মধ্যে প্রবেশ করেছিল । আযমকে তিনি শেষ যে চিঠিটি লিখেছিলেন তাতে স্মৃতিকাতরতা, দীর্ঘ অলঙ্কৃত বাক্যে তিনবার বিদায়সম্ভাষণ করেছিলেন : ‘বিদায়, বিদায়, বিদায় ।
—
আওরঙ্গজেব তিন শতাধিক বছর আগে, ১৭০৭ সালের শীতকালে, এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাকে সমাহিত করা হয় মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদের সাধারণ, ছাদ ও প্রাচীরহীন একটি খোলা কবরে। দিল্লিতে হুমায়ূনের লাল বেলেপাথরের বিশাল সমাধিসৌধ বা আগ্রায় শাহ জাহানের জাঁকজমকপূর্ণ তাজ মহলে অপরিমিত ব্যয়ে নির্মিত বিশ্রামাগারের বিপরীতে আওরঙ্গজেবের কবরটি তাকে স্মরণ করার মতো কোনো তাগিদ সৃষ্টি করেনি। আওরঙ্গজেবের ইচ্ছানুযায়ী একটি সুফি দরগার মধ্যে সমতল ও চিহ্নহীন স্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। কয়েক শ’ বছরের ব্যাপ্তিতে এতে মার্বেলের মেঝ হয়েছে, মার্বেলের রেলিং লাগানো হয়েছে, শনাক্তকারী ফলকও সংযোজন করা হয়েছে। অবশ্য, এসব অলঙ্করণ সত্ত্বেও আওরঙ্গজেবের সমাধির সাদামাটা অবস্থা তার পূর্বসূরীদের সমাধিস্থল ও জাগতিক কীর্তিগাঁথা জোরালোভাবে প্রকাশকারী পাথরের ব্লকগুলোর প্রবল বিপরীত কথাই জানায় ।
আওরঙ্গজেব হয়তো বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দুনিয়া তাকে ছেড়ে দিতে রাজি নয়। একুশ শতকের ভারত ও পাকিস্তানের জনসাধারণের স্মৃতিতে তিনি স্পন্দমান একটি চরিত্র। ভারতে লোকজন তার আমল নিয়ে উত্তপ্তভাবে বিতর্কে নিয়োজিত হয়, প্রায়ই হিন্দুদের প্রতি জঘন্য নির্যাতন করার জন্য তার নিন্দা করে। আওরঙ্গজেব নিজের কৃতকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুললেও বর্তমান ভারতের অনেকেই সংশয়হীনভাবে মনে করে যে তিনি ছিলেন উগ্র গোঁড়া, তরবারির জোরে শাসন করতেন, পেছনে রেখে গেছেন হিন্দু অশ্রুধারা। আধুনিক ভারতের অবয়ব থেকে আওরঙ্গজেবকে মুছে ফেলার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রয়াসগুলো (দিল্লিতে আওরঙ্গজেব সড়কের নাম পরিবর্তন করা এমনই একটি কাজ) এই সম্রাট ও ভারতের ইসলামি অতীতবিষয়ক বিতর্কে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছে। কাছের পাকিস্তানে আওরঙ্গজেব স্রেফ কিছুটা ভালো অবস্থায় আছেন। সেখানে অনেকে ভারতীয় ধারার আলোকে মনে করে যে আওরঙ্গজেব সুস্পষ্টভাবে গোঁড়া ছিলেন। তবে অন্যরা তাকে অতীত কালের মুসলিম সত্যনিষ্ঠ শাসকদের একজন মনে করে। এসব আধুনিক ধারণায় ইতিহাসের বক্তব্য থাকে খুবই সামান্য ।
আরো ভালোভাবে বলা যায়, আওরঙ্গজেব-সম্পর্কিত মিথ্যা তথ্য ও নিন্দাবাদ একুশ শতকের দক্ষিণ এশিয়াকে ছেয়ে ফেলায় লোকটি নিজে একটি হেঁয়ালি হিসেবেই রয়ে গেছেন।
—
আওরঙ্গজেব ছিলেন বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত মোগল সাম্রাজ্যের ষষ্ট শাসক । উপমহাদেশের বাইরের দুনিয়ায় বর্তমানে খুব কমই মোগলদের কথা স্মরণ করা হয়, কিন্তু তাদের আমলে তারা ছিলেন তীব্র মোহিনী শক্তিসম্পন্ন, সম্ভ্রম জাগানিয়া। ১৬০০ সাল নাগাদ মোগল সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা ছিল পুরো ইউরোপের চেয়ে বেশি, সারা পৃথিবীতে মোগলদের সম্পদের কোনো তুলনা ছিল না। এক রক্তাক্ত উত্তরাধিকারের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আওরঙ্গজেব ক্ষমতায় আসেন ১৬৫৮ সালে ৷ এই লড়াইয়ে তার দুই ভাই মারা যান, একজন বার্মায় পালিয়ে যান এবং তার পিতা কারারুদ্ধ হন। আওরঙ্গজেব নিজের নাম রাখেন ‘বিশ্বজয়ী’ (আলমগীর), তার ৪৯ বছরের রাজত্বকালে একটার পর একটা রাজ্য দখল করে নামকরণকে যথার্থ প্রতিপন্ন করেছেন ।