—
আওরঙ্গজেব ১৬৭৯ সালে দিল্লি ত্যাগ করেন, আর কখনো উত্তর ভারতে ফিরে আসেননি। ১৬৮১ সাল থেকে তিনি দাক্ষিণাত্যের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন, বিরামহীনভাবে অভিযানে নিয়োজিত ছিলেন বিশাল অস্থায়ী লাল তাঁবুতে বাস করে। আওরঙ্গজেবের পূর্বপুরুষেরা প্রায়ই তাঁবুতে (মোগল রাজকীয় চিহ্ন লাল রঙের) বাস করতেন, এখানেও আওরঙ্গজেব উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ঐতিহ্য অনুসরণ করেছেন। মোগল জীবনযাত্রা যাযাবর শেকড়ে ফিরে যাওয়ায় আওরঙ্গজেব অতুচ্চ মোগল সংস্কৃতির অনেক স্বকীয় বৈশিষ্ট্যসহ তার নিজের অগ্রাধিকার ও রুচির ওপর জোর দিয়েছেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অর্ধ শতকজুড়ে শাসনকালে আওরঙ্গজেব প্রতিদিন এবং কখনো কখনো দিনে দুবার করেও দরবার ডাকতেন। তিনি ন্যায়বিচার করা নিয়ে গর্ব করতেন, অনেক সময় আবেদনকারীর জবাব নিজে লিখতেন। তিনি জ্যোতিষীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। এটি ছিল মোগল রাজকীয় কার্যক্রমের অন্যতম অনুষঙ্গ। এমনকি আঠার শতকেও তা অব্যাহত ছিল। ১৬৯০-এর দশকে ভারতবর্ষ সফরকারী ইতালির পর্যটক গেমেলি ক্যারেরি লিখেছেন যে ‘সম্রাট [আওরঙ্গজেব] তার জ্যোতিষীদের পরামর্শ ছাড়া কোনো কাজই করেন না।’ ১৭০৭ সালে মৃত্যুর সামান্য আগে এক জ্যোতিষী সুপারিশ করেন যে জ্বর ভালো করার জন্য সম্রাটকে একটি হাতি ও একটি হীরা দান করতে হবে। হাতি দান করার হিন্দু ও ফারসি রীতি অনুসরণ করার পরামর্শটি অযৌক্তিক বিবেচনা করে প্রত্যাখ্যান করেন আওরঙ্গজেব । তবে তিনি গরিবদের মধ্যে ৪০০০ রুপি দান করেন। উল্লেখ্য, ৪৯ বছরের শাসনকালজুড়ে এ ধরনের জ্যোতিষী সম্রাটের কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে ।
আরো সাধারণভাবে বলা যায়, আওরঙ্গজেব জীবনের শেষ দিকে তার শাসনের অনেক আগে থেকেই মোগল রাজকীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হওয়া হিন্দু আদর্শ, ধর্মগ্রন্থ ও সংস্কৃতি থেকে কোনোভাবেই দূরে ছিলেন না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৯০-এর দশকে চন্দ্রমান নামের এক কবি রামায়ণের ফরাসি ভাষ্য নারগিসিস্তান (নার্সিসাস উদ্যান) আওরঙ্গজেবকে উৎসর্গ করেন। ১৭০৫ সালে অমর সিং একই কাজ করে তার গদ্য ফারসি রামায়ণ (অমর প্রকাশ নামে) আওরঙ্গজেবকে উৎসর্গ করেন। আকবর প্রথম ফারসি রামায়ণের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। এটি দুই মহান সংস্কৃত মহাকাব্যের অন্যতম ও ষোড়শ শতকের শেষ দিকের এই সময়কালে ছিল অনেক হিন্দুর কাছে প্রধান ধর্মতাত্ত্বিক গ্রন্থ। পরের শত বছরে কবিরা অসংখ্য স্বতন্ত্র ফারসি রামায়ণ রচনা করেন, এগুলোর কিছু কিছু ক্ষমতায় থাকা মোগল সম্রাটদের উৎসর্গ করেন। এমনকি রাজত্বের শেষ দিকেও আওরজঙ্গজেব মোগল রাজত্ব ও রামের মহাকাব্যিক কাহিনীর মধ্যকার কথিত সম্পৃক্ততার অবসান ঘটিয়ে মোগল সাংস্কৃতিক প্রথা থেকে খুব বেশি দূরে সরে যাননি ।
8. হিন্দুস্তানের শাসক
তার বিশাল সাম্রাজ্য সুরক্ষা করা
শাহ জাহান সপ্তাহে এক দিন দরবার আয়োজনে অভ্যস্ত ছিলেন এবং সত্যনিষ্ঠতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিময় ছিলেন, কারোরই তার কাছে অভিযোগ জানানোর প্রয়োজন হতো না। এখন আওরঙ্গজেব দিনে দুবার দরবারের আয়োজন করেন এবং অভিযোগের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে।
–ভীমসেন স্যাক্সেনা, আওরঙ্গজেব প্রশাসনের হিন্দু সদস্য, ফারসিতে লিখিত
আওরঙ্গজেব একটি বিশাল সাম্রাজ্যের তত্ত্বাবধান করতেন। ফলে একটি বিরাট আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল। তিনি সাম্রাজ্যের বেশির ভাগ অংশে নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন না, বরং নিজের শাসনামলের প্রথমার্ধের বেশির ভাগ সময় দিল্লিতে ও শেষার্ধ প্রধানত দাক্ষিণাত্য অভিযানে ব্যয় করেছেন। মোগল সাম্রাজ্য পরিচালনার দৈনন্দিন কাজের দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের কাঁধে। অবশ্য ন্যায়বিচারের প্রতি নাছোড়বান্দা মনোভাবের কারণে আওরঙ্গজেবের শারীরিক দূরত্ব তাকে অনেক প্রশাসনিক কার্যক্রমে ব্যক্তিগতভাবে সম্পৃক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারত না ।
আওরঙ্গজেব বিপুলসংখ্যক নিউজ বুলেটিনের (আখবারাত, যুবরাজদের দরবারগুলোর খবরাখবর নিয়ে এগুলো প্রতিদিন তার কাছে আসত। এতে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের কার্যক্রম ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর তথ্য থাকত) মাধ্যমে তার রাজ্যের সব প্রান্তের ঘটনাবলী সম্পর্কে অবগত থাকতেন। ওই সময়ের সব নেতাই এ ধরনের সংবাদ বুলেটিনের ওপর নির্ভর করতেন। এসব বুলেটিন আওরঙ্গজেবের দরবারে কী ঘটছে, সে সম্পর্কিত তথ্যও তার শত্রু ও মিত্র সবাইকে অবগত করত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ডাচ দূত হার্বার্ট ডি জ্যাগার জানিয়েছেন, ১৬৭৭ সালে শিবাজি সংবাদ প্রতিবেদন দিয়ে এত ব্যস্ত থাকতেন যে তিনি বৈঠক করার সময় পর্যন্ত বের করতে সমস্যায় পড়তেন ।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও মোগল রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের আচরণ-সম্পর্কিত প্রতিবেদন শুনতেও অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন আওরঙ্গজেব। এসব ক্ষেত্র প্রায়ই অতি বিশাল সাম্রাজ্যটি শাসন করার আওরঙ্গজেবের প্রয়াসের ত্রুটিগুলো প্রকাশ করে দিত।
—
আওরঙ্গজেব মোগল ভূখণ্ড জুড়ে মৌলিক নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করতেন। তিনি বারবার তার ছেলে ও গুরুত্বপূর্ণ অভিজাতদেরকে রাস্তাঘাটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নিয়ে লিখতেন, সাধারণ প্রজাদের বিরুদ্ধে চুরি ও অন্যান্য অপরাধ প্রতিরোধ করতে না পারার জন্য তাদের তিরস্কার করতেন। অবশ্য, আওরঙ্গজেবের প্রয়াস সত্ত্বেও আইন-শৃঙ্খলা সমস্যা জটিল হয়েছিল মোগল ভারতে, তার রাজত্বের শেষ দিকে সম্ভবত আরো অবনতি ঘটেছিল। এই পর্যায়ে মোগল বাহিনী শিথিলভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, কয়েক দশকের সঙ্ঘাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। অনেক নতুন সৈনিকের মধ্যে মোগল স্বার্থের প্রতি আনুগত্য ছিল দুর্বল। ১৬৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইতালির গেমেলি ক্যারেরি অভিযোগ করেছিলেন যে মোগল ভারত চোরদের থেকে পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে পারে না, যেমনটা পারে সমসাময়িক সাফাভি ও উসমানিয়া সাম্রাজ্য । আওরঙ্গজেব নিজে আর্তনাদ করে বলেছেন যে বুরহানপুর ও আহমদাবাদের মতো বড় বড় নগরীতে পর্যটকদের ওপর ডাকাতি হয়। এতে বোঝা যায়, পল্লী এলাকায় আরো সাংঘাতিক হামলা হতো ।