দ্বিতীয়ত, এবং সম্ভবত অভাবিত বিষয় হলো এই যে আওরঙ্গজেবের নতুন নীতির ফলে প্রতিভাধর ব্যক্তিরা তার ছেলে ও মোগল অভিজাতদের দরবারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আওরঙ্গজেব নিজে সঙ্গীত থেকে বিরত থাকলেও তার কয়েকজন ছেলে উৎসাহভরে সঙ্গীতজ্ঞ ও সঙ্গীত শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ক্যাথেরিন স্কফিল্ড উল্লেখ করেছেন যে আওরঙ্গজেবের আমলে সঙ্গীতের ওপর এত বেশি ইন্দো-ফারসি আকর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল, যা পূর্ববর্তী ৫০০ বছরের ভারতবর্ষের ইতিহাসেও হয়নি। চিত্রকলার ব্যাপারেও একই কথা বলা যেতে পারে। সমসাময়িক প্রমাণে দেখা যায়, ১৬৬০-এর দশকের পর আওরঙ্গজেব চিত্রশিল্পীদের নিয়মিত তহবিল প্রদান করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সম্রাটের বৃদ্ধ বয়সের অনেক ছবি এখনো টিকে আছে। বর্ষীয়ান আওরঙ্গজেবের ছবিগুলো খুব সম্ভবত যুবরাজদের দরবার থেকে এসেছে। এসব দরবারে চিত্রকলা শিল্প বিকশিত হচ্ছিল। এই আমলে ফারসি কবিতাও সমৃদ্ধ হয়েছিল। আর আওরঙ্গজেবের নিজের মেয়ে জেবুন্নিসা ছিলেন প্রখ্যাত কবি। তিনি মাখফি (আড়ালে থাকা ব্যক্তি) ছদ্মনামে লিখতেন ।
সংস্কৃত পণ্ডিতদের দিক থেকে আওরঙ্গজেবের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ফলেও প্রতিভাগুলো উপ-রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকদের কাছে ছড়িয়ে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৫০-এর দশকের শেষ দিকে আওরঙ্গজেবের নির্দেশে বৃত্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর কবিন্দ্রাচার্য মোগল অভিজাত দানিশমন্দ খানের দরবারে নিয়োগ লাভ করেন। পরে তিনি ফরাসি পর্যটক ফ্রাসোয়াঁ বার্নিয়ারকে সহায়তা করেছিলেন। আওরঙ্গজেবের মামা শায়েস্তা খান সংস্কৃত বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃত-সম্পর্কিত প্রকল্পগুলোর উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বাঙলার গভর্নরের দায়িত্ব পালনকালে তিনি আকবরের আমলে অনূদিত মহাভারতের ফরাসি পাণ্ডুলিপির সূচিপত্র তৈরী করার নির্দেশ দেন বসন্ত রাইকে। শায়েস্তা খান নিজে সংস্কৃত কবিতা রচনা করেছিলেন। তার কবিতাগুলো রসকল্পক্রমে সংরক্ষিত রয়েছে। আর সংস্কৃত কবিরা কখনো আওরঙ্গজেবকে স্বীকৃতি দিতে বিরাম দেননি। উদাহরণ হিসেবে দেবদত্তের কথা বলা যেতে পারে। তিনি ছিলেন গুজরাতি নারীদের প্রেমবিলাস নিয়ে লেখা গুজারিশতাকামের লেখক। এই গ্রন্থের সূচনায় তিনি আওরঙ্গজেব ও তার ছেলে আযম শাহের কথা উল্লেখ করেছেন।
—
আওরঙ্গজেবের দরবার ১৬৬৯ সাল থেকে ভিন্ন মনোভাব পোষণ করতে থাকে, কিছু কিছু ব্যাপারে কম কম উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। তবে তারপরও শাহ জাহানের আমলে থাকা মোগল সংস্কৃতির অনেক কিছু অব্যাহত থাকার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এসবের মধ্যে রয়েছে আদালতের শাস্ত্রাচার ও রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা ।
ইউরোপিয়ান পর্যটকেরা আওরঙ্গজেবের দরবারের আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। দরবার পরিচালিত হতো কঠোর বিধিবিধান ও আদেশের মাধ্যমে। সম্রাট আসন গ্রহণ করতেন একটু উঁচু মঞ্চে, দিল্লিতে থাকলে বসতেন ময়ূর সিংহাসনে। এতে যত মনি-মানিক্য ছিল, তা দরবারের দর্শকেরা গুণেও শেষ করতে পারত না। সম্রাট নিজে সিল্কের পোশাক পরতেন, সোনায় মোড়ানো পাগড়ি মাথায় দিতেন, মুক্তা ও রত্নপাথরের ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতেন। মোগল ক্রমপরম্পরা নিজেদের অবস্থান অনুযায়ী অভিজাতেরা দাঁড়াতেন, এই উজ্জ্বল ঝলমলে প্রদর্শনীতে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন । মেঝগুলোতে থাকত মহামূল্যবান কার্পেট, দেয়ালে দেয়ালে শোভা পেত পর্দা । রাজকীয় বাদকদল (নওবাত) আওরঙ্গজেবের সঙ্গীত-বিধিনিষেধের বাইরে ছিল। তারা সদা-প্রস্তুত থাকত। এই বিলাসবহুল পরিবেশে আওরঙ্গজেব উপহার প্রদান করতেন, গ্রহণ করতেন, পর্যটক ও অভিজাতদের স্বাগত জানাতেন, সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা করতেন ।
আওরঙ্গজেবের স্বকীয় আগ্রহে পূর্ববর্তী মোগল সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে ১৬৭০-এর দশকে কয়েকটি বিশালাকার রাজকীয় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাজদরবারে আলেমরা বিশাল বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকল্প ফতোয়া-ই আলমগিরি সম্পন্ন করেন। আট বছর পরিশ্রমের পর হানাফি মাজহাবের শাস্ত্রাচার অনুযায়ী ১৬৭৫ সালে এর রচনার কাজ শেষ হয়। এই সঙ্কলন কাজটি করার সময় মাঝে মাঝে এমনকি জোরে করা পাঠ আওরঙ্গজেব শুনতেন, মাঝে মাঝে সংশোধনের কথা বলতেন। এর পর থেকে সাম্রাজ্যজুড়ে বিচারকেরা এই বই থেকে উদ্ধৃতি দিতেন। বইটি আরবিতে লিখিত হলেও এর পরপরই তা ফারসিতে অনূদিত হয়। এ বইতে আওরঙ্গজেবের ধর্মভক্তি প্রতিফলিত হয়েছে। ন্যায়বিচারের প্রতি আওরঙ্গজেবের আগ্রহ পরিষ্কার আইনি বিধান প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ করে থাকতে পারে। অবশ্য আকবর থেকে পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণার প্রতি বৃহত্তর মোগল ধারাবাহিকতা আওরঙ্গজেবের মাধ্যমে অব্যাহত থাকে। পূর্বপুরুষদের মতো আওরঙ্গজেবও বিশাল একটি রাজকীয় পাঠাগারের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, এমনকি তার পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের জন্য ১০ লাখ রুপি পর্যন্ত ব্যয় করেছিলেন ।
আওরঙ্গজেব ১৬৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে লাহোরের বিশাল বাদশাহি মসজিদের (চিত্র ৩) নির্মাণকাজে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। দিলরাসের গরিবের তাজের বিপরীতে এখানে শাহ জাহানের সৃজনী ক্ষমতার সমকক্ষ হন আওরঙ্গজেব। আওরঙ্গজেবের কৃতিত্বগাঁথা এই মসজিদে ফুলের মটিফ, মার্বেল পাথর ও বাঁকানো কার্নিশসহ চমকপ্রদ ছোঁয়া ছিল। নির্মাণের সময় বাদশাহি মসজিদ ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় মসজিদ। এখানে ৬০ হাজার মুসুল্লি একসাথে নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদটি এখনো দর্শনার্থীদের বিস্মিত করে। সময়ের পরিক্রমায় এবং ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে শিখ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রণজিৎ সিংয়ের গোলন্দাজ ভাণ্ডার হিসেবে ব্যবহারের ফলে ভবনটি কিছু ক্ষতির শিকার হয়েছিল। বর্তমানে এটি আবারো মসজিদ হিসেবে বিরাজ করছে। এর প্রগাঢ় সৌন্দর্য দর্শকদের মধ্যে সম্ভ্রমের উদ্রেক করে, মোগল নান্দনিক রুচিবোধের কথা মনে করিয়ে দেয়।