হিন্দু ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন আওরঙ্গজেব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তিনি ১৬৬১ সালে মহান্ত আনন্দ নাথকে একটি চিঠি লিখে যোগ শাস্ত্রানুসারে তাকে একটি ওষুধ লিখে দিতে বলেছিলেন। ১৬৬০-এর দশকে তিনি পাঞ্জাবে একটি গ্রামে আনন্দ নাথের ভূসম্পত্তি বাড়িয়ে দেন। এ ধরনের যোগাযোগ জাহাঙ্গীরের হিন্দু যোগী যদরূপের সাথে বৈঠক ও আকবরের মথুরার বৈষ্ণব সম্প্রদায়কে ভূমিদানের মতোই ।
কয়েক বছর পর্যন্ত আওরঙ্গজেবের বিনোদনমূলক কার্যক্রম তার পূর্বপুরুষদের মতোই ছিল। মোগল সম্রাটদের প্রিয় অবকাশকেন্দ্র কাশ্মিরে তিনি গ্রীস্মকালটি কাটাতেন, সঙ্গীত উপভোগ করতেন। ওই আমলের স্বল্প-উদ্ধৃত তবে গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসবিদ বখওয়ার খানের ভাষ্যানুযায়ী, বাদশাহ সঙ্গীত কলার ওপর বিশেষজ্ঞ জ্ঞান রাখতেন। ফকিরুল্লাহর ১৬৬৬ সালের সঙ্গীত গবেষণা গ্রন্থ রাগ দর্পণে আওরঙ্গজেবের প্রিয় শিল্পী ও বাদ্যকারদের তালিকা দেওয়া হয়েছে।
—
শাসনকালের দ্বিতীয় দশকে আওরঙ্গজেব তার রাজকীয় আচরণ বদলাতে শুরু করেন। হিন্দু উৎস থেকে আসা অনেক রাজকীয় প্রথা তিনি বাতিল করেন, সঙ্গীতের মতো কিছু কিছু ব্যবস্থার ওপর থেকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করে নেন। তিনি সরকারি দরবারি ইতিহাসবিদের পদটিই বিলুপ্ত করে দেন। আওরঙ্গজেবের দরবারের কঠোরতর নীতিপরায়ণ পরিবেশের কারণেই এমনটা হয়েছিল। তবে মোগল সাম্রাজ্যের অন্যান্য স্থানে এসব পরিবর্তন সামান্যই অনুভূত হয়েছিল ।
আওরঙ্গজেব ১৬৬৮ সাল পর্যন্ত দরবারি ইতিহাসলেখক মোহাম্মদ কাজিমকে পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন। মোগল পাঠাগার ও সরকারি নথিপত্রে প্রবেশগম্যতা ভোগ করতেন কাজিম। মোগল সম্রাটেরা সবসময় দরবারি ইতিহাসবিদ নিয়োগ করেননি। বাবর ও জাহাঙ্গীর নিজেরাই তাদের স্মৃতিকথা লিখেছেন, হুমায়ূনের রাজত্ব সম্পর্কে বেশির ভাগ ইতিহাস লেখা হয়েছে তার মৃত্যুর পর। তবে আকবর ও শাহ জাহান সাধারণ নিয়ম হিসেবে বেতনভোগী ইতিহাসবিদ নিয়োগ করেছিলেন। পূর্ববর্তী মোগল সম্রাটদের মধ্যে এ দুজনই ছিলেন তর্কসাপেক্ষে আওরঙ্গজেবের কাছে প্রধান দুই দৃষ্টান্ত । মোহাম্মদ কাজিমের আলমগিরনামা (আওরঙ্গজেব আলমগিরের ইতিহাস) হাতে পাওয়ার পর এই রীতি থেকে বের হয়ে আসেন আওরঙ্গজেব। এ গ্রন্থটি আওরঙ্গজেবের প্রথম ১০ বছরের ইতিহাস। এরপর কাজিমকে অন্য দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়।
দরবারি ইতিহাসলেখকের প্রতি কেন বিরূপ হয়েছিলেন আওরঙ্গজেব তা এখনো অস্পষ্ট রয়ে গেছে। তার হঠাৎ করে সরকারি ইতিহাসের প্রতি বিরূপ হওয়ার কারণ নির্ণয়ে অনেক গবেষক প্রয়াস চালিয়েছেন। তারা নানা কারণ অনুমান করেছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে বাদশাহর অতিমাত্রায় ধার্মিক হয়ে পড়ার ফলে ধর্মতত্ত্ব ছাড়া অন্য সব বইয়ের প্রতি বিতৃষ্ণ হওয়া, রাজকোষাগার খালি হয়ে যাওয়া। রাজদরবারে এর পরবর্তী সময়ের ঘটনাপ্রবাহের দিকে নজর দেওয়া হলে এসব যুক্তি টেকে না। ঘটনা যা-ই হোক না কেন, আওরঙ্গজেব আর কোনো ইতিহাসবিদকে নিয়োগ করেননি, তবে তিনি ইতিহাস লেখার ওপর নিষেধাজ্ঞাও জারি করেননি। যদিও পরবর্তীকালের ইতিহাস লেখকদের ভ্রান্ত পাঠের কারণে ২০ শতকের অনেক ইতিহাসবিদ আওরঙ্গজেব নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। অনেক মোগল কর্মকর্তা আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর সময়ে বা এর সামান্য পরপরই ফারসি ভাষায় ইতিহাস লিখেছেন। এগুলো আজও আমাদের কাছে রয়েছে।
আওরঙ্গজেব ১৬৬০-এর দশকে অনেক দরবারি সৌজন্যবিধিতে পরিবর্তন করেছেন। ১৬৬৯ সালে তিনি দৈনন্দিন দর্শনে হাজির হওয়ার প্রথা বাতিল করেন । প্রায় একই সময়ে তিনি সোনা ও রুপা দিয়ে জন্মদিনে ওজন করার প্রথা রদ করেন বলে জানা যায়। তিনি দরবারের অনেক অনুষ্ঠান থেকে সঙ্গীতজ্ঞদের সরিয়ে নেন, তাদেরকে অন্য দায়িত্বে নিয়োজিত করেন। মজার ব্যাপার হলো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের বেতন বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
এসব পরিবর্তনের অনেকগুলো হয়তো সাধারণ রাষ্ট্রনায়কোচিত জ্ঞান থেকে করা হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে ঝারোকা জানালায় প্রতিদিন আবির্ভূত হওয়ার কথা বলা যায়। অনাকাঙ্ক্ষিত রাজকীয় উত্তেজনা এড়াতেই এই প্রথা থেকে সরে আসেন আওরঙ্গজেব। ১৬৫৭ সালে শাহ জাহান অসুস্থ হয়ে পড়লে তার অসুস্থতার খবর চাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি, কারণ তিনি ঝারোকায় হঠাৎ করেই অনুপস্থিত হয়ে পড়েছিলেন । শাহ জাহান বিছানায় ছিলেন মাত্র ১০ দিন। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই মোগল রাজপুত্রদের মধ্যে সঙ্ঘাতের চাকা ঘুরতে শুরু করে দিয়েছিল ।
অবশ্য আওরঙ্গজেব তার শাসনকালের ১০ বছর পূর্তির সময়কালের দিকে যেসব পরিবর্তন করেছিলেন, সবই বিচক্ষণ ছিল, তা বলা যায় না। উদাহরণ হিসেবে সঙ্গীতের কথা বলা যেতে পারে। এটা সম্ভবত করা হয়েছিল ব্যক্তিগত কারণে। তিনি এ থেকে হয়তো বাস্তব উপকার পাচ্ছিলেন না, এবং ব্যক্তিগত রুচির বিষয়টিও এতে ছিল। মূল্যবান ধাতু দিয়ে ওজন করানোর প্রথার ব্যাপারেও একই ধরনের মনোভাব পোষণ করে থাকতে পারেন। অবশ্য শেষ জীবনে তিনি এ ব্যাপারে তার মন পরিবর্তন করেছিলেন। আওরঙ্গজেব তার নাতি বিদার বখতের জন্য ওজন পরিমাপ প্রথা অনুসরণের সুপারিশ করেছিলেন, সম্ভবত নিজের জন্যও তা শুরু করেছিলেন। এ ব্যাপারে ১৬৯০ সালে ইউরোপিয়ান পর্যটক জন অভিঙ্গটনের একটি প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। আওরঙ্গজেবের মধ্যে সঙ্গীতের প্রতি তার প্রথম বয়সের উদ্দীপনা আর ফিরে না এলেও শেষ জীবনে তিনি কিন্তু এটিকে যথার্থ রাজকীয় প্রথা বলে অভিহিত করে তার ছেলেকে উপভোগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তারপরও ১৬৬৯ সালের দিকে আওরঙ্গজেব হিন্দু মূল থেকে প্রাপ্ত অনেক প্রথাসহ মোগল সংস্কৃতির সুপরিচিত অনেক অনুষ্ঠান রাজদরবার থেকে উঠিয়ে দেওয়ায় এর সামগ্রিক পরিবর্তনের নিট প্রভাব অস্বীকার করা যায় না ।