—
অনেক সময় আওরঙ্গজেব নিজেকে ভূখণ্ডগত নিয়ন্ত্রণকারীর মতো নয়, বরং তাদের চেয়ে ঊর্ধ্বে থাকা পক্ষপাতহীন, নৈতিক শাসক দাবি করতেন। সম্প্রসারণবাদী একটি রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে এ ধরনের দাবি বিস্ময়করই। একবার দাক্ষিণাত্য ও বাঙলায় অকার্যকরভাবে সৈন্য মোতায়েনের জন্য সদ্য সম্রাট হওয়া আওরঙ্গজেবের সমালোচনা করেছিলেন শাহ জাহান। এর জবাবে আওরঙ্গজেব বলেছিলেন যে দক্ষ বিজয়ীরা সবসময় দক্ষ শাসক হয় না। দক্ষ শাসকেরা প্রধানত ন্যায়পরায়ণ শাসনের দিকেই নজর দেন ।
সমসাময়িক অনেক দলিল-দস্তাবেজে ন্যায়বিচারের প্রতি আওরঙ্গজেবের ঘোষিত ভক্তির জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে ইতালির পর্যটক নিকোলাও মানুচির কথা বলা যেতে পারে। তিনি কোনোভাবেই আওরঙ্গজেবের প্রতি ইতিবাচক ছিলেন না। সেই তিনিও বাদশাহ সম্পর্কে বলেছেন : ‘তিনি বিষণ্ন মেজাজের, সবসময় কোনো না কোনো কাজে নিয়োজিত থাকেন, ন্যায়বিচার করতে আগ্রহী থাকেন, সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে চান।’ হিন্দু জ্যোতিষী ঈশ্বরদাস ১৬৬৩ সালে সংস্কৃত ভাষায় আওরঙ্গজেব সম্পর্কে লিখেছেন। তিনি বাদশাহকে ধর্মপরায়ণ (ধর্মায়া) হিসেবে অভিহিত করে এমনকি উল্লেখ করেছেন যে তার করনীতি ন্যায়সঙ্গত (বিধিত)।
সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে আওরঙ্গজেবের সামগ্রিক মূল্যবোধ ছিল ন্যায়বিচার নিয়ে তার বদ্ধমূল ধারণার ওপর নির্ভরশীল, যদিও চাতুর্যপূর্ণ রাজনীতি ও ক্ষমতার অতৃপ্ত তৃষ্ণা নিবারণের জন্য বেশ বড় মাত্রার কৌশল তাতে জড়িয়ে ছিল। এ কারণে আমরা যদি আওরঙ্গজেবের জীবন ও শাসন সম্পর্কে কোনো কিছু (হিন্দুস্থানের বাদশাহ হওয়ার জন্য তার ভাইদের পদদলিত করা, হিন্দু মন্দিরের প্রতি তার আচরণ ও সুফি মাজারে তার সমাধি হওয়া নিয়ে তার ধারণা) বুঝতে চাই তবে আমাদেরকে অবশ্যই একজন কার্যকর, সাম্যবাদী নেতার অর্থ তিনি কী চিন্তা করেছিলেন, তা পুনঃনির্মাণ করতে হবে। এ দিক থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ওই ব্যাপারগুলোর ওপর আলোকপাত করা, যেখানে আওরঙ্গজেব মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচারবিষয়ক তার নিজের আদর্শের বিরুদ্ধেই গেছেন। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে বিবেচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে তার বাবাকে উৎখাত করা ও দাক্ষিণাত্যের মুসলিম রাজ্যগুলোর বিরুদ্ধে নৃশংস যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া। বাস্তব রাজনীতিতে তাড়িত হয়ে গৃহীত পদক্ষেপগুলো নিয়ে আওরঙ্গজেব প্রায়ই ঝামেলায় পড়ে যেতেন। তার অস্বস্তি ন্যায়পরায়ণ শাসনের প্রতি তার প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে গভীরতা ও সীমারেখা উভয়ের ইঙ্গিতই দেয়।
মহান মোগল ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী
হিন্দুস্তান অঞ্চলে রুটির এই সামান্য টুকরাটি [তথা মোগল সাম্রাজ্য] হলো মহামান্বিত তৈমুর ও আকবরের উদার উপহার ।
-–আওরঙ্গজেব, নাতি বিদার বখতকে লেখা চিঠিতে
একটি সাম্রাজ্যের পাশাপাশি আওরঙ্গজেব এমন একটি বর্ণাঢ্য মোগল অতীতের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন যাতে ছিল সমৃদ্ধ অনুকরণীয় আদর্শ ও ভয়ানক দায়িত্ববোধ। একজন মহান রাজা কিভাবে হওয়া যায়, তার উদাহরণ দিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ রাজকীয় পূর্বপুরুষদের নাম উল্লেখ করেছেন তার লেখালেখিতে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জীবনের শেষ দিকে লেখা এক চিঠিতে আওরঙ্গজেব তার নাতিদেরকে উপদেশ দিয়েছিলেন যে মোগল সাম্রাজ্য হলো তৈমুর ও আকবরের উপহার, পরবর্তী প্রজন্মগুলোর দায়িত্ব হলো এর সামগ্রিক গৌরব সমুন্নত রাখা ।
পূর্বসূরীদের মাধ্যমে আওরঙ্গজেব একটি বিশাল, নানা মাত্রিক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। কয়েক দশক ধরে মোগল বাদশাহরা চমকপ্রদ ভবনরাজি নির্মাণ করেছিলেন, কবি-পণ্ডিতদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, পাণ্ডুলিপির জন্য বিশাল বিশাল পাঠাগার তৈরী করেছেন, চিত্রকর ও শিল্পীদের সহায়তা করেছেন। এসব শিল্প, বুদ্ধিবৃত্তিক ও স্থাপত্য ধারার অনেকগুলোকে স্থায়িত্ব দিয়েছেন আওরঙ্গজেব, আবার কোনো কোনোটিকে বাতিল করেছেন, পরিমার্জিত করেছেন। তিনি কখনো তার মোগল উত্তরাধিকারকে লঙ্ঘন করেননি, তবে তার নিজস্ব স্বতন্ত্র সৃষ্টিতে পরিশীলিত করেছেন ।
—
শুরুতে শাহ জাহান ও অন্যান্য মোগল সম্রাটের অনুসরণ করা সাংস্কৃতিক ও দরবারি কার্যক্রম কঠোরভাবে অনুসরণ করেছিলেন আওরঙ্গজেব ।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাদশাহ হিসেবে প্রথম কয়েক বছর সময়কালের মধ্যে আওরঙ্গজেব তার প্রথম স্ত্রী দিলরাস বানু বেগমের জন্য আওরঙ্গবাদে একটি স্মারক সমাধি নির্মাণ করেন। তার এই স্ত্রী ১৬৫৭ সালে পঞ্চম সন্তান জন্মদানকালে প্রসবজনিত জটিলতায় পরলোকগমন করেছিলেন। উজ্জ্বল শ্বেতশুভ্র এ সমাধি ক্ষেত্রটি বিবি কা মাকরাবা (রানির সমাধি) নামে পরিচিত। এটি ছিল শাহ জাহানের তাজ মহলের দৃশ্যমান অনুকরণ। অবশ্য আকারে ছিল অর্ধেক এবং বাইরের দিকে মার্বেল পাথর না দিয়ে প্রলেপ দিয়ে অলঙ্কৃত করা হয়েছিল। বর্তমানে এর নাম গরিবের তাজ। আওরঙ্গজেব এখানে স্বীকৃত মানসম্পন্ন মোগল সমাধি দিয়ে স্ত্রীকে সম্মানিত করার স্বপ্নাবিভাবের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি।
আওরঙ্গজেব তার প্রথম ১০ বছরের শাসনকালে হিন্দু রীতিনীতি থেকে উদ্ভূত অনেক মোগল রাজকীয় প্রথা বহাল রেখেছিলেন। তার রাজকীয় চেহারার দর্শন তথা শুভ দৃষ্টিপাত দিতে তিনি প্রতিদিন সকালে ঝরোকা প্রাসাদের জানালায় দৃশ্যমান হতেন। চান্দ্র ও সৌর জন্মদিনে তিনি প্রকাশ্যে সোনা ও রুপা দিয়ে ওজন করিয়ে তা গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে দিতেন। আকবরের আমল থেকে এ হিন্দু প্রথাটি মোগলরা অনুসরণ করত ৷