পিতার সাথে অন্যায় আচরণের বিষয়টি কোনোভাবেই সামাল দিতে পারেননি আওরঙ্গজেব। এই ঝঞ্ঝাটময় সূচনা তার পুরো শাসনকালে সমস্যা সৃষ্টি করে গেছে, এমনকি তার ধর্মানুরাগেও প্রভাব ফেলেছে বলে আমরা দেখতে পাব। প্রথম দিকের এই ঘটনাও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আওরঙ্গজেবের প্রতিশ্রুতিকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে, অবশ্য তা উচ্চাকাঙ্ক্ষায় সীমিত হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ শাসনকালে আওরঙ্গজেব তার নীতি ও তার রাজনীতির মধ্যে নানা সঙ্ঘাতময় অবস্থার মুখে পড়েছেন, খুব কমই নীতি জয়ী হয়েছে।
—
সূচনায় আওরঙ্গজেবের ঝামেলায় ও সমস্যায় থাকলেও ১৭০৭ সালে মৃত্যু পর্যন্ত ৪৯ বছর মোগল সাম্রাজ্য শাসন করেছেন। তিনি প্রায়ই বিদ্রোহের মুখে পড়েছেন। তবে এমন অবস্থায় সব মোগল শাসকই পড়েছিলেন। তিনি ছিলেন ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম বাদশাহ ।
৩. আওরঙ্গজেব শাসনকালের মহা পথ-পরিক্রমা
সম্প্রসারণ ও ন্যায়বিচার
আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে শ্রেষ্ঠ বিজয়ীরা সবসময় শ্রেষ্ঠ রাজা হন না। দুনিয়ার জাতিগুলো প্রায়ই স্রেফ অসভ্য বর্বরদের অধীনস্ত হয়, সবচেয়ে বিপুল বিজয়ও মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ভেঙে খান খান হয়ে যায়। সে-ই সত্যিকারের রাজা, যার জীবনের প্রধান কাজ হয় সাম্যের সাথে তার প্রজাদের শাসন করা ।
-–আওরঙ্গজেব, সদ্য সিংহাসনচ্যুত শাহ জাহানকে লেখা পত্ৰ
আওরঙ্গজেব একটি সম্পদশালী, সমৃদ্ধশীল ও সম্প্রসারণমুখী সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। তার বাবা শাহ জাহানের আমলে মোগল রাষ্ট্রের রাজস্ব বেড়েছিল। শাহ জাহান খ্যাতিমান ছিলেন নির্মাণ প্রকল্পের জন্যও। তিনি আগ্রার তাজ মহল ও দিল্লিতে শাহজাহানাবাদ নির্মাণে অর্থের ব্যবস্থা করেছিলেন । আর আওরঙ্গজেবের কৃতিত্ব ছিল রাজকীয় সীমান্ত সম্প্রসারণে ।
শাসনকালজুড়ে আওরঙ্গজেব একের পর এক বিদ্রোহ দমন করেছেন, ঠাণ্ডা মাথায় সম্প্রসারণ যুদ্ধ করেছেন, নির্দয় অবরোধ তদারকি করেছেন। তিনি বিশেষ করে তার রাজত্বের প্রথম ভাগে (১৬৫৮-৮১) মোগল সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ ও সুসংহতকরণে কূটনীতির প্রয়োগ করে প্রায়ই খুশি থাকতেন। তবে মোগল এলাকা আরো বড় করতে শক্তিপ্রয়োগ করতে দ্বিধা করেননি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৬০-এর দশকে মোগল রাজ্যের প্রতি মারাঠা হুমকি দমন করার জন্য মারাঠা নেতা শিবাজিকে রাজকীয় চাকরিতে যোগদান করতে প্রলুব্ধ করেছিলেন। ওই প্রয়াস ব্যর্থ হওয়ার পর আওরঙ্গজেব সহিংস হয়ে ওঠেন, বাকি জীবন মারাঠাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। এতে তিনি সীমিত সফলতা পেয়েছিলেন। মোগল কব্জা থেকে যারা শিবাজিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল বলে তার মনে হয়েছিল, তাদেরকেও তিনি শাস্তি দিয়েছেন, বেনারাস ও মথুরার মন্দির ধ্বংস করেছেন ।
আওরঙ্গজেব তার শাসনকালের প্রথমার্ধে মোগল সাম্রাজ্যের অখণ্ডতার প্রতি আরো অনেক সশস্ত্র হুমকির মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি এসবের প্রতি সামান্যই কোমলতা প্রদর্শন করেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মোগল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেওয়ার জন্য ১৬৭৫ সালে তিনি শিখ গুরু তেগ বাহাদুরের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। রাঠোর ও সিসোদিয়া রাজপুতেরা ১৬৭০-এর দশকের শেষ দিকে বিদ্রোহ করেছিল। আওরঙ্গজেব উভয় গ্রুপকে দমন করে রাজকীয় পতাকাতলে আনার জন্য সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সাথে আপসকারী পরিবার সদস্যদের বিরুদ্ধেও আওরঙ্গজেব কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আওরঙ্গজেবের ছেলে যুবরাজ আকবর ১৬৮১ সালে বিদ্রোহ করলে তাকে ধাওয়া করা হয়। বাবার ক্রোধ থেকে রক্ষা পেতে তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই ইরানে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। সেখানেই তিনি ১৭০৪ সালে মারা যান ।
—
আওরঙ্গজেব ১৬৮১ সালে তার পুরো রাজদরবার নিয়ে দক্ষিণ দিকে রওনা হন। এটি ছিল নজিরবিহীন পদক্ষেপ। তার লক্ষ্য ছিল দাক্ষিণাত্যকে রাজকীয় কর্তৃত্বের আওতায় নিয়ে আসা। আকবরের আমল থেকেই দাক্ষিণাত্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাচ্ছিল মোগলেরা। কোনো কোনো সম্রাট দক্ষিণ দিকে আক্রমণ চালিয়েছিলেন, কিন্তু আওরঙ্গজেব প্রথম সম্রাট হিসেবে দাক্ষিণাত্যের বেশির ভাগ অংশে মোগল শক্তি সম্প্রসারণ করেন।
আওরঙ্গজেব তার শাসনকালের দ্বিতীয়ার্ধ (১৬৮১-১৭০৭) দক্ষিণ ভারতে ব্যয় করে মোগল সাম্রাজ্যকে সর্বোচ্চ সীমায় সম্প্রসারিত করেন। তিনি ১৬৮০ এর দশকে বিজাপুর ও গোলকোন্ডা অবরোধ করেন, উভয় সালতানাতকে তার অধীনে আনার ব্যবস্থা করেন। ১৬৯০ ও ১৭০০-এর দশকে তিনি মারাঠাদের বজ্রমুষ্টি থেকে তামিল নাড়ু ও দক্ষিণে অনেক পাহাড়ি দুর্গ দখল করেন। অবশ্য এসব কাজে তিনি প্রবল প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে থাকেন। ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেব যখন মারা যান, তত দিনে মোগল সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা সমসাময়িক ইউরোপের দ্বিগুণ হয়ে গেছে, মোগল ভৌগোলিক এলাকা সর্বকালের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছে ।
যুদ্ধ ও শক্তির প্রতি সংকল্পবদ্ধ থাকার দিক থেকে আওরঙ্গজেব তার পূর্বপুরুষদের চেয়ে সামান্যই ভিন্ন ছিলেন। তবে তিনি ব্যাপক আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন, উল্লেখযোগ্য সফলতা প্রদর্শন করেছিলেন। ঐক্যবদ্ধ মোগল সাম্রাজ্য সমুন্নত রাখার গুরুভার ও সম্ভব হলে এর সীমান্তগুলো সম্প্রসারণ করার দায়িত্ব আওরঙ্গজেবের কাঁধের ওপর ভারী বোঝা চাপিয়ে তার মধ্যে আগ্রাসী সামরিক উদ্যোগ গ্রহণের মানসিকতা গড়ে তুলেছিলেন। তবে মোগল সিংহাসনে বসার মধ্যে কেবল রক্তপাত ঘটানো ও মানচিত্র ক্রমাগত বড় করার চেয়েও বেশি কিছু সম্পৃক্ত ছিল। আওরঙ্গজেবের মধ্যে জাগতিক শক্তির জন্য তার আকাঙ্ক্ষার সাথে ছিল ন্যায়বিচার (আদল) নিশ্চিত করার ধারণা ।