আওরঙ্গজেবের খুনে পদক্ষেপগুলো আধুনিক পাঠকের কাছে সন্দেহাতীতভাবে কঠোর মনে হতে পারে। তবে তার ভাইয়েরাও ভিন্ন কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করতেন না। মানুচি বিষয়টি ধরে রাখতে পেরেছিলেন। তিনি লিখেছেন, মৃত্যুর দিন দারা শুকোহকে আওরঙ্গজেব জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাদের ভূমিকা বিপরীত হলে তিনি কী করতেন? দেয়ালের লিখন দেখতে পেয়ে দারা বিদ্রূপ করে বলেছিলেন যে তিনি আওরঙ্গজেবের লাশ চার টুকরা করে দিল্লির চার প্রধান ফটকে ঝুলিয়ে রাখতেন। তুলনামূলকভাবে আওরঙ্গজেব সংযমের পরিচয়ই দিয়েছিলেন। তিনি দারা শুকোহর লাশ দিল্লির হুমায়ূনের সমাধিতে কবর দেওয়ার নির্দেশ দেন। দারা সেখানেই বিশ্রামে রয়েছেন।
—
কঠিন মোগল নজির অনুসরণ করার পর আওরঙ্গজেব করুণা প্রদর্শন করেন, এমনকি দারা শুকোহ ও অন্য ভাইদের বেশির ভাগ সাবেক সমর্থকের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করেন, এমনকি তাদের যোগ্যতার মূল্যায়নও করেন। তিনি প্রতিহিংসার পথ অবলম্বন না করে তার ভাইদের সৈন্য ও প্রধান উপদেষ্টাদের তার নিজের সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে নিয়ে আসেন। ধনী গুজরাতি জৈন বণিক শান্তিদাসের কাছ থেকে মুরাদ যে ঋণ গ্রহণ করেছিলেন, তিনি তা পরিশোধ করেন। ১৬৭০ এর দশকে আওরঙ্গজেব এমনকি তার মেয়ে জুবেদাতুন্নিসাকে দারা শুকোহর ছোট ছেলে সিপিহর শুকোহর সাথে বিয়ে দেন এবং তার ছেলে যুবরাজ আকবরের সাথে সোলায়মান শুকোহর মেয়ের বিয়ে দেন। দারার মাত্র কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মীর প্রতি কোনো দয়া প্রদর্শন করা হয়নি। এদের একজন হলেন সারমাদ। আর্মেনিয়ান ইহুদি সন্ন্যাসী সারমাদ উদ্ভট আচরণের জন্য পরিচিত ছিলেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে দারা শুকোহই সিংহাসনে আসীন হবেন। আওরঙ্গজেব ১৬৬১ সালে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন।
দারা শুকোহর সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের ওপর আওরঙ্গজেব অনেক বেশি শানিত আক্রমণ চালিয়েছিলেন। ১৬৪৯-এর দশক ও ১৬৫০-এর দশকে শাহ জাহানের দরবারে অবস্থানকালে দারা শুকোহ ধর্ম, সাহিত্য ও আধ্যাত্মিক সাধনায় প্রচুর সময় ব্যয় করেছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণদের একটি দলকে ৫০টি উপনিষদ ফারসি ভাষায় অনুবাদ করার নির্দেশ দেন। এই অনুবাদ পরে ফ্রান্সে পাওয়া গিয়েছিল। এর মাধ্যমেই সংস্কৃত সাহিত্য সম্পর্কে অবগত হয়েছিল ইউরোপ। পাঞ্জাবি আধ্যাত্মিক নেতা বাবা লালের সাথে তার দার্শনিক কথোপকথন হয়েছিল। দারা ফারসিতে গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘দুই সাগরের মোহনা’ রচনা করেন। এতে তিনি দেখিয়েছেন যে হিন্দুধর্ম ও ইসলামধর্ম একই লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হয়েছে। গবেষণা গ্রন্থটি সমুদ্রসঙ্গম নামে সংস্কৃতে অনুবাদ হয়েছে ।
সাবেক সম্ভাব্য উত্তরসূরী হিসেবে স্বীকৃত ব্যক্তিটির হিন্দু দর্শনের, বিশেষ করে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রতি প্রবল আগ্রহের কারণেই আওরঙ্গজেব এর সুস্পষ্ট বিরোধিতায় অবতীর্ণ হন। তিনি দারা শুকোহর আন্তঃসাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেন, বেনারসের ব্রাহ্মণ কবিন্দ্রচার্য সরস্বতীর রাজকীয় বৃত্তি বাতিল করে দিয়ে শাহ জাহান ও সংস্কৃত সাংস্কৃতিক বিশ্বের মধ্যকার দীর্ঘ দিনের সম্পর্কের ইতি ঘটান। বৃত্তি আবার চালুর জন্য চেষ্টা করেছিলেন কবিন্দ্রচার্য। কিন্তু সফল হতে পারেননি। এসবের মাধ্যমে বড় ভাইয়ের সাংস্কৃতিক অনুরাগ থেকে নিজেকে আলাদা করতে চেয়েছেন আওরঙ্গজেব।
—
শাহ জাহানের অস্পষ্ট উপস্থিতি যে প্রশ্ন সৃষ্টি করেছিল, সে তুলনায় দারা শুকোহ ও তার কীর্তি সামাল দেওয়া ছিল নিতান্তই তুচ্ছ বিষয়। আওরঙ্গজেব যখন সিংহাসনে বসেন, তত দিনে শাহ জাহান সুস্থ হয়ে গেছেন। মূলত, আওরঙ্গজেব তার বাবাকে আগ্রার লাল কেল্লায় বন্দী করে রেখেছিলেন। অনেকে মর্জিমতো ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে তাজমহল দেখানোর লোভ দেখিয়ে তাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে চাবি ফেলে দেওয়া হয়েছিল। পঞ্চম মোগল বাদশাহ তার জীবনের শেষ সাড়ে সাত বছর গৃহবন্দী অবস্থায় কাটিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে তাকে সঙ্গ দিতেন তার বড় মেয়ে জাহানারা। অনেকে শাহ জাহানকে সিংহাসনচ্যুত করা ও বন্দী করার তীব্র নিন্দা করে। তবে তার কারাবন্দী বাবার ট্রাজেডি তার শাসনের প্রথম দিকে তার জন্য জ্বালাতন সৃষ্টিকারী সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছিলেন ।
সিংহাসনের জন্য ভাইদের মধ্যে লড়াই মোগলদের মধ্যে গ্রহণযোগ্য রীতি হিসেবে বিদ্যমান থাকলেও ক্ষমতাসীন বাবাকে ক্ষমতাচ্যুত করা খারাপ কাজ বিবেচিত হতো । প্রধান কাজি (মুসলিম বিচারপতি) বিষয়টিকে এত কঠোরভাবে নিয়েছিলেন যে তিনি রাজকীয় ক্রোধের ঝুঁকি নিয়েই শাহ জাহানের জীবিতকালে আওরঙ্গজেবের সিংহাসন আরোহণকে অনুমোদন করতে অস্বীকৃতি জানান। আওরঙ্গজেব তাকে বরখাস্ত করে ওই পদে আরো নমনীয় আবদুল ওয়াহাবকে নিযুক্ত করেন ।
ভারতবর্ষের বাইরেও শাহ জাহানের প্রতি আওরঙ্গজেবের নৃশংসতা নানা জটিলতার সৃষ্টি করে। মক্কার শরিফ আওরঙ্গজেবকে হিন্দুস্তানের যথার্থ শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানান, এমনকি তিনি শাহ জাহানের প্রতি অসদাচরণ করার কারণে কয়েক বছর পর্যন্ত আওরঙ্গজেবের আর্থিক উপহার গ্রহণ করেননি। আওরঙ্গজেবের রাজকীয় পদবি ‘আলমগীর’ (বিশ্বজয়ী) নিয়ে বিদ্রূপ করে সাফাভি রাজা শাহ সোলায়মান (শাসনকাল ১৬৬৬-৯৪) এক তিক্ত পত্র লিখেন। নিজেকে ভুলভাবে বিশ্বজয়ী (আলম-গিরি) হিসেবে অভিহিত করার জন্য আওরঙ্গজেবের সমালোচনা করে শাহ সোলায়মান বলেন, তিনি তো কেবল তার বাবাকে জয় (পিদর-গিরি) করেছেন। আওরঙ্গজেব তার ন্যায়বিচারের অবস্থান প্রতিপন্ন করার জন্য সিংহাসনে আরোহণের সময় অনেক ধরনের কর (কয়েকটি সূত্র মোট ৮০টির কথা জানিয়েছে) মওকুফ করে দিয়েছিলেন। তবে আওরঙ্গজেব তার বাবাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন বলে যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়, তার জবাবে তিনি যা বলেছিলেন তা ছিল ডাহা অসত্য ঘোষণা। তিনি সাফাভি রাজা শাহ সোলায়মানকে (ভুলভাবে) জানিয়েছিলেন যে শাহ জাহান স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণ করে আওরঙ্গজেবকে মুকুট প্রদান করেছেন ।