আওরঙ্গজেব ও শাহ সুজা ১৬৫৯ সালের জানুয়ারিতে এলাহাবাদের উত্তর পশ্চিম দিকে খাজওয়ায় যুদ্ধে নামলেন। শেষ মুহূর্তে শাহ জাহানের সাবেক অনুগত রাজপুত যশোবন্ত সিং দল ত্যাগ করা সত্ত্বেও সুজার চেয়ে আওরঙ্গজেবের বাহিনী ছিল অনেক বড়, ২:১। কিন্তু তবুও তীব্র লড়াই হয়। জানা যায়, একপর্যায়ে আওরঙ্গজেব তার হাতির পাগুলো বেঁধে ফেলার হুকুম দেন প্রাণিটির পলায়ন রোধ করার জন্য। আওরঙ্গজেবের দৃঢ়তা তার লোকদের মনোবল চাঙ্গা করে, তারা সুজার বাহিনীকে পরাজিত করে। সুজা পালিয়ে যান। পরের দেড় বছর ধরে আওরঙ্গজেবের বাহিনী ক্রমাগত সুজাকে তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে, শেষ পর্যন্ত তাকে ভারতবর্ষই ত্যাগ করতে বাধ্য করে। ১৬৬০ সালের মে মাসে শাহ সুজা তার পরিবার নিয়ে নৌপথে ঢাকা ছাড়েন। তারা বার্মায় যান। সেখানে তারা আরাকানের শাসকের হাতে মারা পড়েন। আরাকানের শাসক সম্ভবত আশঙ্কা করেছিলেন যে মোগল যুবরাজ অভ্যুত্থান করতে পারেন। তবে এসব ঘটনার সত্যতা ও সুজার মৃত্যু নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে।
এদিকে ভারতবর্ষে উত্তরাধিকার লড়াইয়ের শেষ বড় যুদ্ধটি হয় ১৬৫৯ সালের মার্চের তিন দিন। দারা ২০ হাজার লোকের একটি বাহিনী (এদের বেশির ভাগ গুজরাত থেকে সংগ্রহ করা) গঠন করে আজমিরের বাইরে পাহাড়ে পাহাড়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি আশা করেছিলেন, এই বন্ধুর এলাকা, পরিখা ও প্রতিরক্ষা প্রাচীর তার সৈন্য স্বল্পতা কাটাতে সহায়ক হবে। আওরঙ্গজেব গোলন্দাজ বাহিনী দিয়ে লড়াই শুরু করেন। দুদিন ধরে এই আক্রমণ শানানো হয়। ফলে পুরো এলাকা ঘন ধোয়ায় ঢেকে যায় ৷ আওরঙ্গজেবের দরবারি ইতিহাসবিদের ভাষায়, ‘বারুদের ধোয়া বজ্রসহ প্রবল মেঘের মতো যুদ্ধক্ষেত্র অন্ধকার করে ফেলে। এমনভাবে স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হলো, ভূমি জ্বলে ওঠল যে মনে হলো পরশ পাথরের শক্তি দেখছি আমরা।’ আওরঙ্গজেব তৃতীয় দিনে দারার একটি অংশের দিকে আক্রমণ কেন্দ্ৰীভূত করলেন। রাজকীয় বাহিনীর বেশির ভাগ অংশ সামনাসামনি যুদ্ধ করলেও একটি অংশ গোপনে পেছনে চলে গিয়েছিল। তারাই যুদ্ধকে আওরঙ্গজেবের অনুকূলে নিয়ে আসে। সেনাবাহিনীর পেছনে অবস্থান নিয়ে নিজের বাহিনীর কচুকাটা অবস্থা দেখে আবারো জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যান দারা ।
তিন মাস ধরে পালিয়ে বেড়ালেন দারা। তারপর ভুল করে মালিক জিওয়ান নামের এক আফগান গোত্রপতির আশ্রয় কামনা করলেন। কয়েক বছর আগে তিনি শাহ জাহানের কাছে করুণা ভিক্ষা করে এই লোকের জীবন রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু ভাবাবেগে আক্রান্ত না হয়ে মালিক জিওয়ান দ্রুত দারাকে গ্রেফতার করে আওরঙ্গজেবের বন্দী হিসেবে তাকে দিল্লি পাঠিয়ে দেন ।
জীবন ও মৃত্যু
একজন সম্রাটকে কোমলতা ও কঠোরতার মাঝামাঝি অবস্থান গ্রহণ করতে হয় ৷
–আওরঙ্গজেব
আওরঙ্গজেব প্রথমবারের মতো নিজেকে মোগল সাম্রাজ্যের বাদশাহ হিসেবে ঘোষণা করার প্রায় এক বছর পর ১৬৫৯ সালের ১৫ জুন তার দ্বিতীয় অভিষেক অনুষ্ঠান উদযাপন করেন। এবার মোগল সম্পদের বিপুল জৌলুস প্রদর্শিত হয় । গায়কদের দল আওরঙ্গজেবের বিশালত্ব ঘোষণা করে, সঙ্গীতজ্ঞরা মনি-মানিক্য উপহার লাভ করেন, আর এত পরিমাণ কাপড় ব্যবহৃত হয় যে ‘সাত মহাদেশের বণিকেরা বিপুল পরিমাণে লাভবান হয়।’ এবার মুদ্রা প্রচলন করা হয়, আওরঙ্গজেব আলমগীরের (বিশ্বজয়ী সিংহাসন উজ্জ্বলকারী) নামে খুতবা পাঠ করা হয়।
এখন ৪০ বছর বয়স্ক আওরঙ্গজেব তার ক্ষমতা লাভের দুই বছরের দ্বন্দ্বের ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিরসন করতে নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। প্রথমে দারা শুকোহর বিষয়টি ফয়সালা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ছিলেন সাবেক সম্ভাব্য উত্তরসূরী ও উত্তরসূরীর লড়াইয়ে আওরঙ্গজেবের সবচেয়ে প্রবল শত্রু ।
দারা শুকোহ ১৬৫৯ সালের গ্রীষ্মকালের শেষ দিকে বন্দী হিসেবে দিল্লি পৌঁছেন। আওরঙ্গজেব তাকে ও তার ১৪ বছর বয়স্ক ছেলে সিপহর শুকোহকে ছেঁড়া কাপড় পরিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরানোর নির্দেশ দেন। পরাজিত দু’জনকে খোলা, রোগাক্রান্ত হাতির পিঠে চড়ানো হয়। সেপ্টেম্বরের ঝলসানো রোদে এমন করুণ দৃশ্য দেখা কঠিন ছিল। তাদের পেছনে উপস্থিত ছিল এক সৈনিক। তারা যাতে পালানোর বেপরোয়া কোনো চেষ্টা না করেন, সেটা জানাতেই সে ছিল তৈরী। অবশ্য, মোগল প্রজারা আগেও এ ধরনের মর্যাদাহানিকর প্রদর্শনী দেখেছে। দারা বছর দেড়েক আগে শাহ সুজার পক্ষের কয়েকজনকে আগ্রায় অবমাননাকরভাবে ঘুরিয়ে ছিলেন। কিন্তু মোগল যুবরাজদের সাথে এমন অমর্যাদাপূর্ণ আচরণ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। ফ্রাসোয়াঁ বার্নিয়ার বলেছেন যে সমবেত লোকজন দারা শুকোহ ও তার কিশোর ছেলের প্রকাশ্য অবমাননার এই দৃশ্য দেখে গুটিয়ে গিয়ে ছিল ।
পরের দিন আওরঙ্গজেবের সরাসরি নির্দেশ দারা শুকোহর শিরোশ্ছেদ করা হয়। কোনো কোনো সূত্র উল্লেখ করেছে যে মৃত্যুদণ্ডাদেশের যৌক্তিকতা প্ৰতিপন্ন করতে দারার ইসলাম থেকে কথিত মুরতাদ হওয়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন আওরঙ্গজেব। তবে অন্যরা কেবল মৃত্যুদণ্ডাদেশের কথাই উল্লেখ করেন। এর কয়েক বছর পর পূর্ববর্তী একটি খুনের বদলার অজুহাতে মুরাদকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এতে মনে হয়, যত ঠুনকো অজুহাতই হোক না কেন, ভাইদের হত্যা করার বিষয়টি যৌক্তিক করতে চেয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। সম্ভবত ন্যায়বিচারভিত্তিক শাসন পরিচালনাকারী রাজার জন্য এ ধরনের ব্যাখ্যা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে দারার দুই ছেলের বড় জন তথা সোলায়মান শুকোহর জন্য কোনো যুক্তি দেওয়ার দরকার মনে করেননি আওরঙ্গজেব। ১৬৬১ সালে তার জন্য অতিরিক্ত মাত্রায় আফিম পানি দেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি ।