কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আওরঙ্গজেব ও মুরাদের মধ্যে টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়। মুরাদ তার সৈন্যদের বেতন বাড়িয়ে দেন, দ্রুত পদোন্নতির প্রতিশ্রুতি দেন, আনুগত্য বদল করার জন্য আওরঙ্গজেবের সৈন্যদের অনেককে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। বড় ভাইয়ের তাগিদ সত্ত্বেও দারা শুকোহর পিছু ধাওয়ার ব্যাপারে গড়িমশি করতে থাকেন মুরাদ। তিনি এমনকি আওরঙ্গজেবের সাথে বৈঠকও এড়িয়ে যান। আওরঙ্গজেব তখন সিদ্ধান্ত নেন যে মুরাদ তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছেন ।
আওরঙ্গজেব ১৬৫৮ সালের গ্রীস্মে ছোট ভাইকে তার সাথে ব্যক্তিগত সাক্ষাতে প্রলুব্ধ করতে অসুস্থতার ভান করেন। খাওয়া দাওয়ার পর মুরাদ বিশ্রাম নিতে রাজি হয়ে নিরস্ত্র হন। এই কাহিনীর পরবর্তীকালের সংস্করণগুলোতে বলা হয় যে মুরাদ মদ্য পান করেন (আর আওরঙ্গজেব সংযত ছিলেন) বা মর্দনকারীদের দক্ষ হাতের কারসাজিতে আয়েসের জগতে চলে যান, তরুণ যুবরাজের চিন্তাভাবনা বিনাশ করে দেওয়া ভোগে লিপ্ত হন, তাকে গভীরভাবে অবচেতন করে ফেলা হয়। প্রতিরক্ষাহীন হওয়া মাত্র আওরঙ্গজেবের সৈন্যরা মুরাদকে গ্রেফতার করে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে ফেলে। ছোট ভাইয়ের ২০ হাজার সদস্যের বাহিনীকে আত্মস্ত করে নিতে বিলম্ব করেননি আওরঙ্গজেব।
হিন্দুস্তানের সম্রাট
উৎসব যখন খোদ বেহেশতের মতো সজ্জিত হয়, তখন আকাশও তাদের আসন ছেড়ে নৃত্য করে ।
-–কাফি খানের উদ্ধৃতি। আওরঙ্গজেবের প্রথম অভিষেকের বর্ণনা এভাবেই দিয়েছেন আঠার শতকের এই ইতিহাসবিদ
মুরাদ কারারুদ্ধ, শাহ জাহান বন্দী, দারা পলাতক- এমন অবস্থায় প্রথম অভিষেক অনুষ্ঠান আয়োজন করতে যথেষ্ট বেশি সময়ই নিয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। ১৬৫৮ সালের ৩১ জুলাই জ্যোতিষীদের কাছে শুভ বলে বিবেচিত দিনটিতে দিল্লির শালিমার গার্ডেন্সে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করে আলমগীর (বিশ্বজয়ী) রাজকীয় পদবি গ্রহণ করেন তিনি ।
আওরঙ্গজেব মোগল প্রথা অনুসরণ করে সঙ্গীতের আয়োজন করার নির্দেশ দেন, উপহার বণ্টন করেন। তবে নিজের নামে মুদ্রা প্রচলন ও জুমার নামাজে খুতবা প্রদানের রীতি অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকেন। স্বল্প পরিসরের অনুষ্ঠান হলেও এর মাধ্যমেই আওরঙ্গজেব যুগের সূচনা ঘটে। কয়েক বছর পর আঁকা প্রথম অভিষেক অনুষ্ঠানের ছবিতে একইসাথে সরলতা ও উদ্দীপনার সমাবেশ দৃষ্টিগোচর হয়। ছবিতে কালো দাড়িতে তরুণ আওরঙ্গজেব হাঁটু ভাজ করে রয়েছেন। রাজদরবার সফরকারী পরবর্তীকালের লোকজন তার উঁচু নাসিকা ও জলপাই রঙের যে ত্বকের বর্ণনা দিয়েছে, এই ছবিতে তাকে তেমনই দেখা যায়। ছবিতে তিনি সোজা হয়ে বসে ছিলেন, শেষ বয়সে তার কাঁধ ঝুঁকে পড়ার যেসব চিত্র দেখা যায়, তা এতে অনুপস্থিত। ছবিতে আর মাত্র দুটি মানুষ দৃশ্যমান। এতে অনুষ্ঠানটি যে সংক্ষিপ্ত ছিল, তার ইঙ্গিত মেলে। অখণ্ড মোগল সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধ, মানসম্পন্ন শাসনের উচ্চাশায় আঁকা ছবিতে বেহেশতি অনুমোদনের চিহ্ন হিসেবে উপরে কালো মেঘ ভেদ করে সদ্য মুকুট পরা সম্রাটের ওপর আলোর ঝরনাধারা নেমে আসতে দেখা যায় (ছবি-২)।
—
প্রাথমিক অভিষেকের পর আওরঙ্গজেব তার তখনো মুক্ত থাকা দুই ভাই দারা শুকোহ ও শাহ সুজাকে বাগে আনার কাজ শুরু করলেন ।
আওরঙ্গজেব কয়েক মাস ধরে দারাকে অনুসরণ করে গেলেন। তাকে তিনি প্রথমে লাহোরে শনাক্ত করেন, তারপর তাকে মুলতানে তাড়িয়ে নেন, পরে আরো দক্ষিণে সিন্ধু নদ পথে এগিয়ে চলেন। ধরা পড়া এড়ানোর জন্য দারা শুকোহ তার ক্রমশ ছোট হতে থাকা বাহিনীকে দুর্গম এলাকা দিয়ে পরিচালিত করেন, কখনো বিশুদ্ধ পানির ধারা এড়িয়ে জঙ্গল কেটে সফর করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত তিনি গুজরাতে তার পথচলার সমাপ্তি টানেন, তত দিনে অনেক সমর্থকই তার সাথে ছিল না। ১৬৫৮ সালের সেপ্টেম্বরে দারাকে ধরার কাজটি তার অনুগত কর্মকর্তাদের হাতে ন্যস্ত করে আওরঙ্গজেব দিল্লির দিকে যাত্রা শুরু করেন শাহ সুজাকে সামাল দেওয়ার জন্য ।
শাহ সুজা আগের বছরটি অত্যন্ত ব্যস্ত কাটিয়েছিলেন। ১৬৫৭ সালে শাহ জাহানের অসুস্থতার খবর পেয়ে তিনি নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা করে জাঁকজমকপূর্ণ আবুল ফৌজ (বিজয়ের পিতা) নাসরুদ্দিন (বিশ্বাসের রক্ষক) মোহাম্মদ তৃতীয় তৈমুর দ্বিতীয় আলেকজান্ডার শাহ সুজা বাহাদুর গাজি পদবি ধারণ করেন। তবে শাহ সুজার মোগল সাম্রাজ্য শাসন করার স্বপ্ন স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল। ১৬৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে (ওই বছরের মে মাসে সামুগড়ের যুদ্ধের আগে, যেখানে আওরঙ্গজেব ও মুরাদের যৌথ বাহিনী দারা শুকোহর বাহিনীকে হারিয়েছিল) শাহ সুজা যুদ্ধে নামেন দারা শুকোহর বাহিনীর বিরুদ্ধে। বেনারাসের কাছে হওয়া ওই যুদ্ধে দারার বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন তার ছেলে সোলায়মান শুকোহ । যুদ্ধে শাহ সুজা শোচনীয়ভাবে পর্যুদস্ত হন । এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুদ্ধক্ষেত্রে এত রক্ত ঝড়েছিল যে ঘাসগুলো টিউলিপ ফুলের রঙ ধারণ করেছিল। ১৬৫৮ সালের মে মাসে সুজাকে এক চিঠি লিখে আওরঙ্গজেব জানালেন, তিনি যদি সম্রাট ঘোষণা থেকে সরে আসেন, তবে তার ওপর আওরঙ্গজেব সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশের শাসনভার ন্যস্ত করবেন। সুজা প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন।