শাহ জাহানের অসুস্থতার সময় দিল্লির দরবারে উপস্থিতি ছিলেন একমাত্র দারা শুকোহ। তার ভাইয়েরা তখন সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো নিয়ন্ত্ৰণ করছিলেন। পূর্বে শাহ সুজা নিয়ন্ত্রণ করতেন বাংলা, পশ্চিমে মুরাদ পরিচালনা করতেন গুজরাত, আর দক্ষিণে আওরঙ্গজেব নিয়োজিত ছিলেন দাক্ষিণাত্যে। ভাইদের কাছে সংবাদপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টায় দারা চরদের আটকিয়ে ও রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। শাহ জাহানের অসুস্থতার খবর শুনেই তিন ছোট ভাই দারার ক্ষমতা গ্রহণ, তাদের খুন করার ষড়যন্ত্র ও তাদের বাবাকে বন্দী করা নিয়ে গুজব দিয়ে তাদের কান ভারী করে ফেললেন । চার মাত্রিক প্রতিযোগিতা দানা বেঁধে ওঠার প্রেক্ষাপটে সাম্রাজ্যের অভিজাতেরাও পক্ষাবলম্বন করেন। শাহ সুজা ও মুরাদ ছিলেন প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী, উভয়ের হাতে ছিল বিপুল সমর্থন। তবে মূল প্রতিযোগিতা হয়েছিল দারা ও আওরঙ্গজেবের মধ্যে। বেশির ভাগ মোগল অভিজাত এই দুজনের কোনো একজনকে সমর্থন করতেন। রাজপরিবারের নারীরাও মোগল উত্তরাধিকার লড়াইয়ে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। শাহ জাহানের তিন মেয়ে তাদের প্রিয়জনকে সিংহাসনের বসানোর জন্য বাছাই করে নেন। বড় মেয়ে জাহানারা সমর্থন করতেন দারা শুকোহকে, মেজ মেয়ে রোশানারা সমর্থন করতেন আওরঙ্গজেবকে। আর সবার ছোট মেয়ে গৌহারারা ছিলেন মুরাদের পক্ষে। দারার বিরুদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মুরাদের সাথে শিথিল মিত্রতায় আবদ্ধ হন আওরঙ্গজেব ।
—
বাবার মৃত্যু নিয়ে ভুল খবর বিশ্বাস করে ১৬৫৭ সালের ডিসেম্বরে মুরাদ নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা করেন, গুজরাতে অভিষেক অনুষ্ঠানও আয়োজন করলেন। আওরঙ্গজেবের কাছে আগেভাগে মুরাদের নিজেকে সম্রাট ঘোষণার চেয়েও বেশি হুমকিপূর্ণ ছিল মোগল সাম্রাজ্যের অন্যতম সম্পদশালী রাজ্য গুজরাতে মুরাদের শক্তিশালী অবস্থান ও তার হাতে থাকা বিপুলসংখ্যক সৈন্য । ছোট ভাইকে মিষ্টি কথায় তুষ্ট করে গুজরাত থেকে বের করার জন্য আওরঙ্গজেব তাকে প্রতিশ্রুতি দেন (তিনি সম্ভবত এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার কোনো ইচ্ছা তিনি পোষণ করেননি) : আওরঙ্গজেব ওয়াদা করেন যে দারা শুকোহ ও শাহ সুজাকে পরাজিত করার পর তিনি মোগল সাম্রাজ্যের উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাংশ মুরাদের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেবেন। ইতিহাসবিদ ঈশ্বরদাস জানান যে আওরঙ্গজেব এমনকি তার ভাইকে একটি ফরাসি প্রবাদবাক্যের উদ্ধৃতিও দেন : দুই হৃদয় একসাথে হলে চিড়ে যায় পর্বত।’ এই কপটতায় কাজ হয়। গুজরাত থেকে বের হয়ে আসেন মুরাদ। আওরঙ্গজেবের বাহিনীর সাথে তার বাহিনী মিলে ১৬৫৮ সালের এপ্রিলে উজ্জায়িনির কাছে ধারমতে রাজকীয় বাহিনীকে পরাজিত করে। দুই ভাইয়ের পরবর্তী গন্তব্য ছিল দিল্লি। তখন তাদের লক্ষ্য মোগল সাম্রাজ্যের কেন্দ্র জয় করা।
আওরঙ্গজেব ও মুরাদের যৌথ বাহিনী ১৬৫৮ সালের মে মাসের এক প্রচণ্ড উত্তপ্ত দিনে আগ্রার ঠিক পূর্ব প্রান্তে দারা শুকোহর ৫০ হাজার সদস্যের শক্তিশালী বাহিনীর মুখোমুখি হয়। সামুগড়ের লড়াই (ছবি ১) হিসেবে বর্তমানে পরিচিত এই প্রচণ্ড সঙ্ঘাতই মোগল উত্তরাধিকার সঙ্কটের ফয়সালাসূচক মুহূর্ত বিবেচিত হয়। সংঘর্ষের আগের দিন আওরঙ্গজেব তার ও মুরাদের বাহিনীকে বিশ্রামে রাখেন। আর দারার সৈন্যরা ভারী যুদ্ধসাজে প্রচণ্ড রোদে তাদের শত্রুর বাহিনীর প্রতীক্ষায় থাকে। তাদের শক্তি ক্ষয় হয়, দারার সেনাবাহিনীর অনেকে গরমেই কাবু হয়ে পড়ে, তাদের শেষ করার জন্য শত্রুর আঘাতের প্রয়োজন পড়েনি ।
পরের দিন ভোরে শুরু হলো যুদ্ধ, উভয় পক্ষই গোলন্দাজ বাহিনী, অশ্বারোহী বাহিনী, তীরন্দাজ, যুদ্ধ হাতি বাহিনী ও পদাতিক বাহিনীতে সুসজ্জিত ছিল। আওরঙ্গজেব ও দারা উভয়ে নিজ নিজ হাতিতে সওয়ার হয়ে তাদের বাহিনীর শীর্ষে অবস্থান করছিলেন। তাদের বাহিনী প্রবল যুদ্ধ করছিল, আঠার শতকের এক ইতিহাসবিদের ভাষায় ‘যুদ্ধের তীব্র শব্দ ওই সন্ত্রাস-জর্জরিত ময়দানের ওপরে ওঠে গিয়েছিল।’ দিনের শেষভাগে আওরঙ্গজেবের সৈন্যরা দারা শুকোহকে বহনকারী যুদ্ধহাতিকে লক্ষ্য করে কামানের গোলা ও রকেট নিক্ষেপ করার মতো অবস্থানে অগ্রসর হয়ে পড়ে। জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় দারা হাতি থেকে নেমে ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান। তিনি পেছনে রেখে যান একটি বিশৃঙ্খল ও মনোবল হারা বাহিনী। এই বাহিনী অল্প সময়ের মধ্যেই পর্যুদস্ত হয় ।
দারা শুকোহ আগ্রায় পালিয়ে যান, সেখানে লাল কিল্লায় শাহ জাহান আয়েসে অবস্থান করছিলেন। দারা এরপর দিল্লি হয়ে লাহোরে আত্মগোপন করেন। বড় ভাই যখন বন্দী হওয়া থেকে রক্ষা পেতে ছুটছেন, তখন আওরঙ্গজেব ও মুরাদ আগ্রার লাল কিল্লার দিকে অগ্রসর হন। শাহ জাহান তখন সুস্থ হয়ে ওঠলেও ছিলেন নামমাত্র সম্রাট।
—
শাহ জাহান চেষ্টা করেছিলেন আওরঙ্গজেবের সাথে সাক্ষাত করার। তিনি এমনকি ইউসুফ নবী ও ইয়াকুব নবীর কয়েক বছরের বিচ্ছেদের পর মিলন হওয়া নিয়ে পবিত্র কোরআনে থাকা ঘটনার উদ্ধৃতিও দেন। তিনি চাচ্ছিলেন ছেলেকে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে তার সাথে সাক্ষাত করতে। প্রতারিত হওয়ার শঙ্কায় আওরঙ্গজেব তা প্রত্যাখ্যান করেন। এর বদলে ১৬৫৮ সালের জুনের শুরুতে তিনি ও মুরাদ আগ্রা দুর্গ অবরোধ করে এর পানি সরবরাহ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেন। শাহ জাহান ছিলেন দুর্গের ভেতরে। কয়েক দিন পর তিনি দুর্গের ফটক খুলে দিয়ে তার কোষাগার, অস্ত্রভাণ্ডার ও নিজেকে তার ছোট দুই ছেলের কাছে উন্মুক্ত করে দেন। বড় মেয়ে জাহানারাকে মধ্যস্ততাকারী হিসেবে ব্যবহার করে শেষ চাল হিসেবে শাহ জাহান সাম্রাজ্যকে পাঁচ ভাগে ভাগ করার একটি প্রস্তাবে রাজি করানোর চেষ্টা করেছিলেন আওরঙ্গজেবকে। তিনি তিন ভাইকে সাম্রাজ্যের তিন অংশ এবং আওরঙ্গজেবের বড় ছেলে মোহাম্মদ সুলতানকে (মৃত্যু ১৬৭৬) একটি অংশ প্রদান করার প্রস্তাব করেন। শাহ জাহানের অবশিষ্ট সমর্থকদের অনেকে দ্রুততার সাথে আওরঙ্গজেবের বিজয়কে মেনে নেন। এমনকি তাদের অবরোধ সম্পন্ন করার আগেই তারা তার প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেছিলেন ।