শাহ জাহান ১৬৫৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক সকালে জেগে মারাত্মক অসুস্থতা বোধ করলেন, প্রাসাদের বারান্দায় প্রজাদের সামনে হাজির হওয়ার দৈনন্দিন কাজটিও করতে পারলেন না। তিনি ওই দিনের দরবারও বাতিল করে দিলেন। শাহ জাহান এক সপ্তাহেরও বেশি সময় জনসাধারণের সামনে উপস্থিত হতে পারলেন না। ফলে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেল। বাদশাহর অসুস্থ হওয়ার খবর তীব্র বেগে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। দোকানদারেরা আতঙ্কিত হলো, লুটপাট বেড়ে গেল। শাহ জাহানের চার ছেলে মনে করলেন, তাদের বাবা মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। ফলে তারা ক্ষমতার এই শূন্যতার সুযোগ গ্রহণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন। প্রচলিত মোগল প্রথা অনুযায়ী, ছলে-বলে-কলে-কৌশলে যিনি জয়ী হবেন, তিনিই হবেন হিন্দুস্তানের পরবর্তী সম্রাট ।
সঙ্ঘাত বন্ধ হতে লাগল প্রায় দুই বছর এবং আওরঙ্গজেব অবিসংবাদিত বিজয়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। সিংহাসনে উত্তরণের পরিক্রমায় আওরঙ্গজেব তার তিন ভাই- দারা শুকোহ, শাহ সুজা ও মুরাদ- ও বাবা শাহ জাহানকে পরাভূত করেছিলেন। ১৬৬০-এর দশকের শেষ দিকে পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের বিরোধ নিষ্পত্তি করার প্রক্রিয়ায় আওরঙ্গজেব তার দুই ভাইকে মৃত্যুদণ্ড দেন, আরেকজনকে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করেন, বাবাকে (তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই সুস্থ হয়ে ওঠেছিলেন) আটকিয়ে রাখেন আগ্রার লাল কেল্লায়। অবিভক্ত মোগল সাম্রাজ্য শাসন করার জন্য একমাত্র আওরঙ্গজেবই এই সহিংসতা থেকে অক্ষতভাবে বের হয়ে আসতে পেরেছিলেন!
ইউরোপিয়ান পর্যটকেরা মোগল রাজপরিবারকে নিমজ্জিত করা নৃশংস, রক্তাক্ত উত্তরাধিকার লড়াইয়ে আতঙ্কিত হয়েছিলেন। কয়েক দশক পর মোগল ভারত সফরকারী ইতালির জেমেলি ক্যারেরি পারিবারিক দ্বন্দ্বকে ‘অপ্রাকৃতিক যুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। আওরঙ্গজেবের শাসনকালের শেষ দিকে সুরাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চ্যাপলিন জন অভিংটন ‘এ ধরনের বর্বর আত্মদানের’ নিন্দা করেছেন, বিষয়টিকে ‘অমানবিক’ হিসেবে অভিহিত করে সমাপ্তি টেনেছেন। ফ্রান্সিস বার্নিয়ার ও নিকোলাও মানুচির মতো অন্যান্য ইউরোপিয়ান পর্যটন লেখক এসব ঘটনা নিয়ে জালিয়াতপূর্ণ ও বিভীষিকাময় দমবন্ধ করা বক্তব্য দিয়েছেন, চার ভাইয়ের, বিশেষ করে আওরঙ্গজেবের ‘আধিপত্য বিস্তারের লোলুপতা’ নিয়ে কথা বলেছেন। ভারতীয় পর্যবেক্ষকেরাও এই ঘটনা উল্লেখ করেছেন, তবে তারা ঘটনায় অনেক কম আশ্চর্য হয়েছেন, অন্তত শুরুতে এর নির্মমতা সম্পর্কে কম সরব ছিলেন।
মোগল রাজকীয় ব্যবস্থা দীর্ঘ দিন ধরেই সুস্পষ্টভাবে ফরাসি বাক্য ইয়া তকত ইয়া তাঁবুত (হয় সিংহাসন নয়তো কবর) নীতিতে পরিচালিত হতো। শাহ জাহান তার দুই ভাইকে (১৬২২ সালে খসরু ও ১৬২৮ সালে শাহরিয়ার) খুন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি দুই ভাতিজা ও দুই কাজিনকে মৃত্যুদণ্ড দেন ১৬২৮ সালে সিংহাসন দখল করার পর। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সাক্ষী দিচ্ছে যে শাহ জাহানের বাবা জাহাঙ্গীর দায়ী ছিলেন জাহাঙ্গীরের ছোট ভাই দানিয়েলের মৃত্যুর জন্য। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে দানিয়েল মারা গিয়েছিলেন বিষাক্ত মদ পানে। এমনকি বাবর ও হুমায়ূনের মতো মোগল শাসনের প্রাথমিক যুগেও ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাই, বাবার বিরুদ্ধে ছেলের সহিংস সঙ্ঘাত দেখা গেছে।
অবশ্য আওরঙ্গজেব ও তার ভাইদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে লড়াই প্রত্যাশিত থাকলেও সময় বা সঙ্ঘাতের ফলাফল পূর্বনির্ধারিত ছিল না।
—
শাহ জাহান ১৬৫৭ সালে ছিলেন ৬৫ বছর বয়স্ক। তখনই তার আগের অন্য চার মোগল সম্রাটের চেয়ে তিনি অনেক বেশি দিন জীবিত ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার অসুস্থতা ছিল আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত। কী কারণে শাহ জাহান মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে পর্যবেক্ষকেরা একমত নন। ইতালির ভ্রমণকারী নিকোলি মানুচি তার বিশেষ রংচং মাখানো কায়দায় দাবি করেছেন যে অসংবৃত এই শাসক অতিরিক্ত মাত্রায় যৌন শক্তি বর্ধক ওষুধ গ্রহণ করেছিলেন। মানুচির স্বদেশী ক্যারেরিও উপসংহার টেনেছেন এই বলে যে অসম্ভব আবেগের বশবতী শাহ জাহান একজন বুড়ো মানুষের স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে অনেক বেশি যৌনতায় মজে গিয়েছিলেন। তবে বাস্তবে তার অসুস্থতার মূল কারণ হতে পারে মুত্রথলি বা আন্ত্রিক কোনো রোগ। যে কারণেই তিনি অসুস্থ হয়ে থাকুন না কেন, এর ফলেই উত্তরাধিকার লড়াই শুরু হয়েছিল, তবে চার যুবরাজের মধ্যকার সঙ্ঘাতের ভিত্তি আরো অনেক আগেই প্রস্তুত হয়েছিল।
আওরঙ্গজেব ১৬৫০-এর দশকের প্রথম দিকে দারা শুকোহর বিরোধিতার লক্ষ্যে শাহ সুজা ও মুরাদের সাথে গোপন মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিন ছোট ভাই জানতেন যে তাদের বাবা তার বড় ছেলেকেই পছন্দ করছেন এবং দারাও হয়তো একই সময় তার ভাইদের খুন করার নিজস্ব পরিকল্পনা প্রণয়ন করছিলেন। সেই ১৬৫২ সালের দিকেও সমসাময়িক একটি ফরাসি ভাষ্যে দারাকে ‘তার ভাইদের রক্ত পান করতে তৃষ্ণার্ত নেকড়ে’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। উত্তরাধিকার যুদ্ধ চলাকালে বলা হয়ে থাকে, শাহ জাহানের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে আওরঙ্গজেব আবারো দারার খুনে প্রবৃত্তির কথা বিশেষ করে আওরঙ্গজেবের নির্দোষ রক্ত নিতে তার ব্যগ্রতার কথা জানিয়েছিলেন। তবে সময়ের পরিক্রমায় দেখা যায়, ভ্রাতৃহত্যার কাজটি করেছিলেন আওরঙ্গজেবই ।