গাঁইয়া হবার ভয় সেকেলে হবার ভয় তো কম ভয় নয়।
অথচ ওই শৈশবের ছোটখাটো ব্রত গুলিকে মূল্যহীন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কবির কথায়–
কুলদেবতার, গৃহদেবতার, গ্রাম দেবতার
বাহিয়া সিঁড়ি জগৎ সবিতা বিশ্বপিতার
চরণে পরাণ যায় যে ভিড়ি।
বর্তমান যুগে জ্ঞান বিজ্ঞানের পথে যতই উন্নতি আসুক, সেই ধ্যান ধারণার লক্ষ্যটি তো স্থির। রাখতে হবে। কাজেই সিঁড়ির প্রয়োজনীয়তাকে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। শৈশবকালই তো হচ্ছে। সেই সিঁড়ির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কাল।
তবে একথাও অস্বীকার করা চলে না, মেয়েদের জীবনে শিক্ষার উৎকর্ষ ও স্বাবলম্বনের আদর্শে লক্ষ্য স্থির রাখতে হলে আমাদের পারিবারিক জীবনের পুরনো ছাঁচটি যথাযথ বজায় রাখা সম্ভব নয়। অথচ সেই ভাঙা ছাঁচের টুকরোগুলিকে কুড়িয়ে নিয়েই জোড়াতালি দিয়ে গুছিয়ে সংসার করতে হচ্ছে এ যুগের গৃহিণীদের।
এ যুগে বোধহয় সব থেকে বিপদগ্রস্ত অবস্থা হচ্ছে গৃহিণীদের।
এঁদের মাথার উপর কুটিল সমালোচকের দৃষ্টি নিয়ে এখনও বিরাজ করছে রাজ্য হারানো সদ্য বিগত কালটি। প্রতিপদেই সে পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হবার চেষ্টামাত্র না করে আপন কালের সঙ্গে একালের তুলনামূলক সমালোচনায় তৎপর।…বৃদ্ধারা আপন বধূজীবনের দুঃখদশার সঙ্গে এ যুগের বধূজীবনের সুখদশার তুলনা করে শ্লেষাত্মক নিশ্বাস ফেলছেন, আর ওদিকে অনাগত কালের ধ্বজাবাহী সন্তান সন্ততিকুল সংসারকে তীব্র বেগে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে আরও ভাঙনের দিকে। অবস্থাটা বিপদজনক বইকি!
এ বিপদ আমাদের মা ঠাকুমাদের ছিল না।
বহির্বিশ্বের খবরমাত্র না জানা নিতান্ত নিরক্ষর সেই কর্ত্রীরা কী প্রবল দাপটেই কর্তৃত্ব করে গেছেন তা এখনো অনেকের স্মৃতির মধ্যেই জীবন্ত আছে। তাদের নিষেধ অলঙ্ঘ্য। তাদের রায় বিধাতার রায়। …তাদের ইচ্ছেই শেষ কথা। সে কথা অকাট্য, তর্কাতীত।
অধস্তনদের সাধ্য কি যে বাদ প্রতিবাদ করবে।
এ মহিমা আজকের গৃহিণীদের কোথায়?
তাদের তো অহরহই বাদ প্রতিবাদের সঙ্গে লড়াই করতে করতে কাজ চালিয়ে যাওয়া।
আজকাল তো আবার ভয় টয় দেখিয়েও কাউকে আয়ত্তে রাখা যায় না, ঠেকানো যায় না কোনো অন্যায় অপ্রিয় ব্যাপারকে। লোকভয়, নিন্দাভয়, সমাজ ভয়, শাস্ত্ৰভয় পাপপুণ্যের ভয়, এসবের আর দাঁত নেই, কাজেই পরিবার পরিচালিকার হাত অস্ত্রশূন্য।
অতএব তার ভূমিকা নিষ্প্রভ।
তিনি জানেন, তার কথাই শেষ কথা নয়। তার নিষেধ অলঙ্ঘ্য নয়। তার রায় বিধাতার রায় নয়।
এর কারণ এ যুগের সংসারের নতুন ছাঁচ।
মেয়েদের স্বাবলম্বনের পরিপ্রেক্ষিতেই এই ছাঁচ।
গৃহিণী যেখানে সংসারের কেন্দ্রস্থলে অচলা সেখানে পারিবারিক শৃঙ্খলাটি থাকে দৃঢ়বদ্ধ। সংসারের সদস্যদের পরস্পরের মধ্যে একটি যোগসূত্র থাকে।
গৃহিণীর সদা সতর্ক দৃষ্টি যেমন সকলের সকল প্রকার অভিযোগ অসন্তোষের নিরাকরণ করে তেমনি কিছু পরিমাণে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে অধস্তনদের অবিনয়, অবাধ্যতা, কর্তব্যচ্যুতি, ব্যবহারিক ত্রুটি, স্বার্থপরতা দায়িত্বহীনতা, ইত্যাদি অসৎ গুণগুলিকে।
কিন্তু গৃহিণী যেখানে সচলা? বাইরের কর্মজীবনের দায়ে দিনের অধিকাংশ সময়ই সংসারে অনুপস্থিত? সেখানে যথোপযুক্ত নিয়ন্ত্রণের আশা কোথায়?…এই অনুপস্থিতির বিনিময়ে অর্থ উপার্জন হলেও–পরিবারের পরিজনবর্গ তাদের প্রাপ্য সেবা যত্ন থেকে বঞ্চিত হয়, এবং ভৃত্য পুত্র ও কন্যারা যথেচ্ছাচারের সুযোগ পায়।
এই সব থেকেই তো অসন্তোষ অভিযোগ আর ঔদ্ধত্যের জন্ম।
কর্ত্রীর কর্তব্যে ঘাটতি ঘটলেই কর্তৃত্বের আসন টলমল করে, শাসনের অধিকার নিরঙ্কুশ থাকে না।
আধুনিক সংসারে গৃহিণীদের সমস্যাসঙ্কুল জীবনে বোধকরি এইটাই সব থেকে বড় সমস্যা শাসনের অধিকার হারানো।
জীবনের বহিক্ষেত্রে অনেক অধিকার অর্জন করলেও এই অন্তরের অন্তঃপুরক্ষেত্রে অধিকার হারানো মেয়েদের অবস্থা আজ সত্যিই শোচনীয়।
গৃহিণীর দায়িত্ব রয়েছে, গৃহিণীর মর্যাদা নেই, পরিচালনার পরিশ্রম আছে, পরিচালনার স্বীকৃতি নেই। অভিভাবিকার ভূমিকা আছে, অভিভাবিকার গৌরব নেই। এ অবস্থা দুঃখের বইকি!
আর চারিদিকে একই অবস্থা, কে কার উদাহরণ দিয়ে সামাল দেবে?
গৃহকর্তাদের অবস্থাও অবশ্য তদ্রূপ, কিন্তু তাদের জ্বালাটা কম। তারা আর বর্তমানের এই বানচাল সংসার তরণীর হালটি ধরতে রাজী নয়। হাতের হাল বৈঠা দাঁড় হাত থেকে নামিয়ে রেখে দর্শকের আসনটি বেছে নিয়েছেন। যেন মেয়েদের অবরোধ মোচনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের দায়িত্বমোচন হয়ে গেছে।
ফলশ্রুতি?
ফলশ্রুতিতে দেখা যাচ্ছে নির্লিপ্ত স্বামী, উদ্ধত সন্তান, দুর্বিনীত ভৃত্য, অবাধ্য শিশু, সহানুভূতিশূন্য আত্মীয়, উদাসীন প্রতিবেশী আর নিত্য বর্ধমান বাজারদর, এই হচ্ছে এ যুগের গৃহিণীদের সংসারের উপকরণ।
এর মধ্যে অবিচল থাকা শক্ত-বইকি।
তাছাড়া এ যুগের প্রতিটি মানুষই যেন অপরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন, আত্মকেন্দ্রিক। কাজেই অন্যের সুখ দুঃখ সুবিধা অসুবিধার প্রতি উদাসীন, পরমত সম্পর্কে অসহিষ্ণু। অথচ পারিবারিক জীবনের আসল মূলধনই তো হচ্ছে পরমত সহিষ্ণুতা, অন্যের সুখ দুঃখ সুবিধা অসুবিধা সম্পর্কে সচেতনতা।
কাজেই একথা বললে ভুল বলা হবে না–যুগের খাজনা যোগাতে যোগাতে আমাদের পারিবারিক জীবনের মূলধন আজ শূন্যের অঙ্কে ঠেকেছে।