- বইয়ের নামঃ সমাজ জীবনে নারীর দায়িত্ব
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
সমাজ জীবনে নারীর দায়িত্ব
সমাজ জীবনে পুরুষের ভূমিকা যতই প্রত্যক্ষ এবং প্রবল হোক, মেয়েদের ভূমিকার গুরুত্ব যে অনেক বেশি একথা অস্বীকার করা যায় না।
সমাজে নারী যতক্ষণ স্থির অবিচল সতর্ক, ততক্ষণ সমাজে ভাঙন ধরার ভয় থাকে না, তা সে পুরুষ যতই উত্তাল অশান্ত উদ্ধৃঙ্খল বা বিভ্রান্ত হোক। বিপরীতটি ঘটলেই সর্বনাশ।
বিগত যুগের সমাজ-জীবনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই এই সত্যটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সমাজে যখনই মেয়েদের মধ্যে চিন্তায় কর্মে ধ্যান ধারণায় বিভ্রান্তি এসেছে, তখনি দেশে বিপত্তি ঘটেছে। যুগে-যুগে ইতিহাস এই শিক্ষাই দিয়ে চলেছে। প্রকৃতপক্ষে কী সমাজ জীবনে, কী পারিবারিক জীবনে, নারীই মেরুদণ্ড স্বরূপ। কারণ মেয়েদের মন স্বভাবতই রক্ষণশীল, মেয়েরাই পুরনো সংস্কার পুরনো বিশ্বাস, পুরনো মূল্যবোধগুলিকে সযত্নে লালন করে, সে ধারা বহন করে নিয়ে চলে পরবর্তী কালের দরবারে।
আর যুগের প্রয়োজনে যে অনিবার্য পরিবর্তন ঘটে সেও আসে মেয়েদেরই জীবনচর্যার পরিপ্রেক্ষিতে। সমাজ ব্যবস্থার ভারসাম্য রক্ষার্থে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে, সেও তো নারীর উপর দিয়েই। দেশে জনসংখ্যার নিরিখে কখনও তাকে শত পুত্রের জননী হবার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়। কখনও বা এক সন্তানের নির্দেশ দেওয়া হয়। এই পরীক্ষা নিরীক্ষা পুরুষের উপর এমন প্রত্যক্ষগোচর নয়।
কারণ ওই একটিই।..নারীই সমাজের, তথা পরিবারের মূল কাঠামো। নারী যেমন পরিবারের পরিচালিকা, তেমনি পরিচারিকাও। সে যেমন সংসারের সেবায়, কল্যাণ চিন্তায়, উৎকর্ষ সাধনায়, মধুর কোমল অনলস, তেমনি আবার সেই সংসারের শুচিতা সভ্যতা শৃঙ্খলা রক্ষার নিয়ম নীতিতে কঠোর কঠিন। নারীর আর এক নাম শ্রী।
নারীর এই ভূমিকাটিই আসল।
ব্যক্তিগত জীবনেও আমরা তার অনেক উদাহরণ দেখতে পাই। একটি গৃহিণীহীন গৃহ শত ঐশ্বর্যশালী হলেও, তার চেহারা শ্রীহীন সৌন্দর্যহীন লক্ষীছাড়া। অপরপক্ষে নিতান্ত দরিদ্রের সংসারও একটি সুগৃহিণীর করস্পর্শে লক্ষ্মীশ্রীমতি শান্ত উজ্জ্বল।
কিন্তু বর্তমান যুগে মেয়েদের জীবনে এসে গেছে বহু জটিল সমস্যা। কেবলমাত্র গৃহকেন্দ্রে অবিচল একটি সুগৃহিণী মাত্র হয়ে থাকলেই তার চলছে না, যুগের পরিবেশে তাকে গৃহগণ্ডীর বাইরে গিয়ে বিশ্বকর্মযজ্ঞের চাকায় পেষাই হতে হচ্ছে। সে চাকার এমন কোনো খাঁজ আর আজ বাকি নেই, যেখানে মেয়েদের দেখা যাচ্ছে না।…আর বিস্ময়ের বিষয় এতখানি বিস্তৃতি আর বিস্তার মাত্র একটি প্রজন্মেই সম্ভব হয়েছে।
সেই যুগটি তো বেশিদিন বিগত হয়নি, যখন বলা হত, মেয়েমানুষের আবার বেশি বেশি লেখা পড়া শিখে কী হবে? অফিসে চাকরী করতে যাবে? না জজ ম্যাজিস্ট্রেট হবে? ধোবা গয়লার হিসেবটা রাখতে শিখলেই যথেষ্ট।
একদা এ ধরনের কথা যাঁরা অবলীলায় উচ্চারণ করেছেন, তাঁদের কেউ কেউ অথবা অনেকেই এখনও জীবিত, কাজেই নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, মাত্র একটি প্রজন্মেই আদরের মেয়েরা তাদের ব্যঙ্গাত্মক প্রশ্নগুলিকে ব্যঙ্গ করে সাহসী জবাব দিয়ে চলেছে।… কিন্তু মুশকিল এই, এতদ্রুত এতখানি পরিবর্তনে ভারসাম্য কিছু ব্যাহত হচ্ছে। এই ভারসাম্য হারানো চেহারা দেখা যাচ্ছে সমাজজীবনে, পারিবারিক জীবনে, তথা ব্যক্তি জীবনে।
যুগযুগ সঞ্চিত, নিভৃত অন্তঃপুরের অভ্যস্ত জীবনচর্চার ধারার উপর আঘাত হানছে নতুন জীবনের জ্ঞানধারা। জানলা খোলা পেয়ে শুধু মুক্ত বাতাসই আসছে না, আসছে ধূলোবালি খড়কুটো।..আলোর সঙ্গে সঙ্গে এসে পড়ছে গৃহদাহকারী অগ্নিকণা।…অনেক দিগন্তের ইসারা আজ মেয়েদেরকে করে তুলেছে কিছুটা দিশাহারা।
বড় গোলমেলে সময়।
এহেন পরিস্থিতিতে ভ্রান্তি আর বিভ্রান্তি এসে পড়া অস্বাভাবিক নয়। সেই এসে পড়াটাই হচ্ছে জটিল সমস্যা।…ভারতবর্ষের মাটিতে দিশাহারাদের জন্য দিশারির অভাব নেই। যুগে যুগে কালে কালে মহামানবরা আসেন পথের নির্দেশ দিতে, আসেন সাধক মহাসাধকরা সে পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে, আসেন সমাজকল্যাণী, চিন্তাবিদ শুদ্ধ আত্মা জ্ঞানীপুরুষরা টালমাটাল নৌকোর হাল ধরতে। তাই বহু আঘাত জর্জরিত, এবং বহু মতবাদে খণ্ডিত ভারতবর্ষ আজও তার অধ্যাত্ম শক্তিকে হারিয়ে বসে নি। তার অবিনশ্বর সত্তাটি আছে অক্ষুণ্ণ।
সাময়িক যে বিভ্রান্তি, সে হচ্ছে পাশ্চাত্য শিক্ষা, আর পাশ্চাত্য ভাবাদর্শের অনুপ্রেরণা, প্রগতির মোহ, এবং তথাকথিত ফ্যাসানের দায়। সেকালের আদর্শটি ভাল লাগলেও, অনেকে সেকেলে বলে অবজ্ঞেয় হবার ভয়ে ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদীক্ষা চালচলন, আচার আচরণের ক্ষেত্রে নিজের রুচির বিপরীতেই কাজ করেন।
এই সেদিন একটি কম বয়সী মহিলাকে আক্ষেপ করতে শুনেছি, আমরা কেমন ছেলেবেলায় ভোরবেলা উঠে শিবপূজো পুন্যিপুকুর করেছি, খুকুকে সে সব ধরাবার সুবিধেই পেলাম না। অথচ কী ভালই যে লাগতো সেই বৈশাখের ভোরের চমৎকার আলো হাওয়ার মধ্যে ফুল চন্দন গঙ্গাজল বেলপাতা নিয়ে ধূপটুপ জ্বেলে বসতে। নিজেকে কেমন পবিত্র পবিত্র আর আস্ত একটা মানুষ বলে মনে হত।…খুকুকে ওসবের স্বাদ তো দূরের কথা মানেই বোঝানো যাবে না। ওর বাবা কাকা পিসি হৈ চৈ করে হেসে আমায় গাঁইয়া প্রতিপন্ন করে ছাড়বে।