এই ভয়ঙ্কর অনাচার দর্শনে অন্যান্য আত্মীয়েরা যখন নিন্দাবাদ করেছে, মা হেসে বলেছেন, ওরা যে আমার ছেলে, ওদের সঙ্গে কি আমার জাতের ভেদাভেদ আছে?
অনেকে আবার অন্যপথে নিবৃত্ত করতে চেয়েছে, বলেছে ওরা শিষ্যা, তুমি গুরু। ওরা শুদ্র, তুমি ব্রাহ্মণ। তোমার এই সেবায় ওদের অকল্যাণ।
সেকথাও মা হেলায় হেসে উড়িয়েছেন। বলেছেন, মা-ছেলের সম্পর্কের কাছে কি আর কোন সম্পর্ক দাঁড়ায়?
মুসলমান প্রজা আমজাদের উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করার কাহিনীটিই বা কে না জানেন?
তখনকার দিনে এতবড় সাহস বোধকরি কল্পনার অতীত, ধারণার অতীত।
মায়ের স্বচ্ছ বলিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গীর আরও একটি উদাহরণ আমরা পাই জনৈক গৃহস্থ ভক্তের ব্যাপারে। এ ঘটনাটিও সে যুগের আলোয় দেখতে হবে।
ওই ভক্তটির স্ত্রী বেচারা ভালমানুষ, কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে তার কষ্টের অবধি নেই। কষ্টের কারণ খোঁজবার দরকার নেই, পরের মেয়েকে লাঞ্ছনা গঞ্জনা উৎপীড়ন আমাদের দেশে নতুন কথা নয়, এসব অকারণেই হত।
মা জানতে পেরে সেই ভক্তটিকে ডেকে বললেন, আর এরকম চললে যে বৌমা মরে যাবে, তুমি বৌমাকে নিয়ে আলাদা বাসা করো।
এ শুধু আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীই নয়, তদানীন্তন কালে রীতিমত সমাজবিপ্লবই বলা চলে।
ভক্তটি বিব্রত হয়ে বললো, মা, এ আদেশ কি করে পালন করি? সামান্য আয়, মা বাপকে পাঠাতে হয়
মা সতেজে বললেন পাঠাতে হবে না। বললেন তাদের আরও ছেলে আছে, তারা কষ্টে। পড়বেন না। বৌমার তুমি ছাড়া আর কে আছে?
শ্রীমার সমসাময়িক আর কোনও বাঙালী মা কি এ মনোভাবের বা এ মনোবলের সমর্থক হতে পারতেন?
এরকম উদাহরণের শেষ নেই।
আবার ভেবে দেখলে উদাহরণটা কিছুই নয়। উদাহরণ তথ্য মাত্র, তত্ত্ব নয়। আর সেই তত্ত্বকে বুঝতে হলে চাই আলাদা অনুভূতি।
কিন্তু শ্রীশ্রীমার তত্ত্ব চিন্তা করতে গেলে, অনুভূতিও বুঝি স্তব্ধ হয়ে যায়। শুধু মনে হয় কে করবে এই তত্ত্বের উদ্ঘাটন?
আমাদের দৌড় ওই তথ্য পর্যন্তই। কাজেকাজেই শ্রীমার ওই সংস্কারমুক্ত মনের পরিচয়বাহক আরও একটি তথ্য পরিবেশন করেই প্রবন্ধ শেষ করি। এই পরম দৃষ্টান্তটি হচ্ছে মায়ের হাতের লিচুকাঁটা বালা।
ঠাকুরের বিয়োগের পর মা সারদামণির হাতে বালা ও পরণে পাড়ওয়ালা শাড়ী রাখাও কি সেকালে কম অসমসাহসিকতা ছিল?
তবু মা দ্বিধা করলেন না।
ঠাকুর অদৃশ্য থেকে বললেন, বালা খুলছ কেন? আমি কি কোথাও গেছি? শুধু এঘর ওঘর বৈ তো নয়। লোকে বললো স্বপ্ন।
মা কিন্তু সাহসের সঙ্গে সেই বাণীকে জীবনে গ্রহণ করলেন।
আত্মীয় মহলে কি সমালোচনা উদ্দাম হয়ে ওঠেনি? নিন্দা হয় নি?
হয়নি এমন কথা বিশ্বাস করা শক্ত।
কিন্তু যিনি আঠারো বছর বয়সে ফলহারিণী কালিকা পূজার রাত্রির সেই ভয়ঙ্কর পরীক্ষা অনায়াসে উত্তীর্ণ হয়ে এসেছেন, তাকে আর কিসে বিচলিত করতে পারবে?
সকলেই অবগত আছি, সে যুগে ইসলামধর্মের তিন তালাকের মত আমাদের পবিত্র হিন্দুসমাজেও সহজে স্ত্রীত্যাগের একটি বিধি ছিল। সে বিধি মা বলা। স্ত্রীকে মা বলে ত্যাগ করেছে মানেই পতিপত্নী সম্পর্ক একেবারে মুছে গেছে।
কিন্তু এই অভাবনীয় মাতৃপূজার পরও মা সারদামণি চির সংস্কারের বেড়াজাল কেটে ক্ষ্যাপা মহাদেবের পাশে পার্বতীর মত নিজেকে উৎসর্গ করছেন সেবায়, প্রেমে, শ্রদ্ধায়, স্নেহে।
এ এক আশ্চর্য সৌন্দর্য।
এ এক আশ্চর্য মহিমা!
ঠাকুরের সঙ্গে পতিপত্নী সম্পর্ক তাঁর নিবিড়তম ও গভীরতমই ছিল। তারও যেমন ক্ষ্যাপা ঠাকুরটির জন্য উদ্বেগের শেষ ছিল না, ছিল না ব্যাকুলতার অন্ত, ঠাকুরটিরও তার চাইতে কিছু কম ছিল না। শ্রীশ্রীমা সন্ন্যাস গ্রহণ করেন নি। লোকে বলতো তিনি ঘোরতর সংসারী। কিন্তু সন্ন্যাস গ্রহণ না করেও দেহাতীত, লোকাতীত, সংসারাতীত। এই অনির্বচনীয় প্রেমকে তিনি নিঃশব্দে বহন করে গিয়েছেন সাধারণ সংসারের খুঁটিনাটির মধ্যে নিমজ্জিত থেকে।
ভারতের এই আদর্শকে আমরা চিরদিন পুঁথির মধ্যেই দেখে এসেছি, মা সারদামণি এলেন আদর্শের মূর্তি হয়ে।
এ আদর্শ একটি মাত্র যুগের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকার নয়, একটি মাত্র দেশের মধ্যে আবদ্ধ থাকার নয়, দেশে দেশে কালে কালে যুগে যুগে এ আদর্শ অবিনশ্বর।
শ্রীমার এই ত্যাগের মধ্যে অহঙ্কার নেই, আত্ম অভিমান নেই, এ ত্যাগ স্বচ্ছন্দ সহজাত।
এ ত্যাগ মোহমুক্ত, সংস্কারমুক্ত, বন্ধনমুক্ত, এ আশ্চর্য মনের সহজ অভিব্যক্তি। এই অপূর্ব অভিব্যক্তিখানিই আমাকে সবচেয়ে আকর্ষণ করে, মুগ্ধ করে, স্তব্ধ করে।