দক্ষিণেশ্বরে নহবৎখানায় বাসকালে এই লজ্জাসরম আশালীনতা বজায় রাখতে কত কৃচ্ছ্বসাধন, কত কষ্টস্বীকার!
এ না করলে লোকশিক্ষা হয় না।
মানুষ যখন দেবতার মধ্যে দেবত্বের বিকাশ দেখে, তখন সে বিচলিত হয় না, বলে এ তো হবেই। তুমি মহৎ, তুমি বৃহৎ কারণ তুমি যে দেবতা! এখানে মানুষের ভূমিকা শুধু স্তুতিগানের।
তুমি প্রভু আমি দাস, তুমি বৃহৎ আমি ক্ষুদ্র, আমি অধমাধম, আমি অযোগ্য–এখানে মানুষ নির্বেদ, নিশ্চেষ্ট। সেই নিশ্চেষ্টতার সুর হচ্ছে প্রভু আমার কোন গুণ নেই, তুমি নিজগুণে আমায় উদ্ধার কর।
কিন্তু মানুষ বিচলিত হয় তখন, যখন সে মানুষের মধ্যে দেবত্বের বিকাশ দেখে। তখন চমকে গিয়ে বলে এ কী? এমনও হয়? তবে কি আমার মধ্যেও রয়েছে এই দিব্য সম্ভাবনা? তবে কি আমিও চেষ্টা করলে মহৎ হতে পারি, বৃহৎ হতে পারি, সুন্দর হতে পারি?
এখানে আমায় তুমি হাত ধরে তোল বলে ধুলোয় পড়ে অপেক্ষা নয়, ধূলিশয্যা ছেড়ে আপনি উঠে দাঁড়ানোর সাধনা।
মানুষের মধ্যে দেবত্বের বিকাশের সাধনা।
তাই তো ঈশ্বর যখন আর্ত পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন, তখন দুঃখীর ভূমিকা গ্রহণ করেন। নইলে যে মানুষ তাকে অবিশ্বাস করবে, দূরে রাখবে। চেষ্টা করবে না।
শ্রীশ্রীমার লীলাভূমিকাও আপাতদৃষ্টিতে দুঃখের বইকি। দীর্ঘ জীবনখানি কেটেছে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে, আপন সংসার বলতে কিছু নেই, অধিকাংশকাল কেটেছে পিতৃগৃহে ভ্রাতৃজায়াদের সংসারে সেবিকারূপে। হাড়ভাঙা পরিশ্রম, পরণে ছিন্নবস্তু, অন্নজোটে তো সে অন্নে লবণ জোটে না। সধবা হয়েও দাম্পত্যজীবনের আস্বাদ নেই।
সঙ্ঘজননীরূপা যে মহিমময়ী মাতৃমূর্তি আমরা দেখি, সে তত দীর্ঘজীবন পার করে এসে পরে।
.
পূর্বোক্ত যে জীবনের ভূমিকা শ্রীশ্রীমা গ্রহণ করেছিলেন, তার প্রত্যেকটিই নিখুঁতভাবে উত্তীর্ণ হয়ে গেছেন।
গৃহস্থ নারীর চারটি রূপ, চারিটি ভূমিকা–কন্যা, ভগিনী, জায়া, জননী।
শ্রীশ্রীমার প্রতিটি রূপই অনবদ্য। কন্যারূপে তিনি অনুপমা, ভগ্নীরূপে অতুলনীয়া, জায়ারূপে অনির্বচনীয়া।
আর জননীরূপে?
সে রূপের বিশেষণ কোথায় খুঁজে পাব? কোন অভিধানে? কোন শব্দকোষে?
তিনি সহিষ্ণুতার প্রতিমা, মমতার প্রতিমা, করুণার প্রতিমা, আর শক্তির প্রতিমা। অথচ এ শক্তিকে তিনি কোনওদিন কোনও ছলে নিজের প্রয়োজনে লাগান নি।
ঠাকুরের দেহান্তের পর রাণী রাসমণির দৌহিত্র ত্রৈলোক্য বিশ্বাসের দেওয়া মাসিক বরাদ্দ সাতটি টাকাও যখন নানা ষড়যন্ত্রে বন্ধ হয়ে গেল, তখনও তিনি নিরুপায় গ্রাম্যনারীর মতই খুদসিদ্ধ খেয়ে দিন কাটিয়ে দিয়েছেন। যে অন্নের উপকরণ মাঠ ঘাট থেকে তুলে আনা শাক।
প্রয়োজনবোধ করলেন না এর চাইতে অধিকতর আয়োজনের।
কিন্তু নিজের জীবনে যিনি কোনও কিছুই অবশ্য প্রয়োজনীয় মনে করেন নি, তিনিই ভারতের অসংখ্য মেয়ের জন্য প্রয়োজন অনুভব করলেন এক বিরাট বস্তুর। শুধু অনুভব নয়, দাবী করে বসলেন। বললেন স্ত্রীশিক্ষা চাই।
স্ত্রীশিক্ষা হলে ভাল হয় নয়, স্ত্রীশিক্ষার দরকার একথা নয়, স্ত্রীশিক্ষা চাই!
বললেন ওরে ওরা বড় দুঃখী, ওদের মধ্যে আলো জ্বেলে দে।
অথচ তখনও বাংলার নারীসমাজে এ সংস্কার বলবৎলেখাপড়া শিখলে মেয়েরা বিধবা হয়।
মা বললেন ছি ওকি কথা! ওসব হলো কর্মফল। জ্ঞান চাই আলো চাই।
তখনও দেশে স্ত্রীশিক্ষার প্রশ্ন নিয়ে বিরাট আন্দোলন, বিরাট দলাদলি চলছে। শহরের মহা মহা শিক্ষিত পণ্ডিত-সমাজের মধ্যেও অধিকাংশই স্ত্রীশিক্ষার বিরোধী, গ্রামাঞ্চলের তো কথাই নেই। সেই পটভূমিকায় জয়রামবাটির একটি প্রৌঢ়ানারী দৃঢ় উক্তি করলেন, মেয়েরা পড়বে বইকি! লেখাপড়া না শিখলে কি ভালমন্দ বোধ জন্মায়?
বাংলাদেশে স্ত্রীশিক্ষায় সারদামণির প্রভাব, প্রেরণা ও অবদানের কথা এখানে আলোচ্য নয়, এখানে আলোচনার বস্তু হচ্ছে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীর।
শ্ৰীমার আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীর আর একটি বড় উদাহরণ ভগিনী নিবেদিতা!
নিবেদিতা দেবীর অংশ। তবু সমাজ-পরিচয়ে তিনি বিদেশী মেয়ে। ব্রাহ্মণসমাজের গোঁড়ামীতে তখনও বিদেশী স্পর্শে স্নান করার প্রথা জোরালো ছিল। বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে। সকলদেশেই সর্বকালেই অন্তঃপুরের শুচিতা রক্ষার ব্যাপারে গোঁড়ামীটা প্রবল থাকে, এদেশে তো আরোই।
কিন্তু শ্রীমা অনায়াসেই নিজেকে সে আচার থেকে মুক্ত করলেন! বিদেশী মেয়ে নিবেদিতাকে কাছে টেনে নিলেন ঘরের মেয়ের মত। হাত ধরে বসালেন, ভাষার ব্যবধান ভেদ করে আলাপ করলেন, তাকে বুঝলেন, বুঝে হৃদয়ের মধ্যে ঠাই দিলেন।
কামারপুকুরে ভক্তরা গেছেন, তারা অনেকে হয়তো অব্রাহ্মণও। আহারের পর তারা নিজেদের উচ্ছিষ্টপাত্র তুলতে গেছেন, মা ব্যস্ত হয়ে বলেছেন, থাক্ থাক্ রেখে দাও, তোমাদের আর কষ্ট পেতে হবে না, ওসব করবার লোক আছে।
সে লোক আর কেউ নয় স্বয়ং মা সারদামণি। কারণ গ্রামের যে সব দুঃখী মেয়েরা এসব কাজকর্ম করে খেতো, তারাও অনেক সময় সকলের উচ্ছিষ্ট ছুঁতে চাইত না। মা পরে ভক্তদের অসাক্ষাতে নিজে সেই সব উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করতেন।
এটা যে কতবড় জিনিস, সেটা আজকের পরিবেশে বিচার করতে গেলে ভুল হবে, বিচার করতে হবে একশো বছর আগের বাংলার গ্রাম-সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে। যেখানে তখনও অচলায়তনের দেওয়াল প্রস্তর কঠিন।