তবে একথা ঠিক, আজ একবার আমাদের মেয়েদের থমকে দাঁড়ানো দরকার। ভাবা দরকার আমরা যে পথে চলেছি, তা ঠিক পথ কিনা। সে পথে কী শান্তি আছে, কল্যাণ আছে? আজকের যে আধুনিক জীবনের দিকে আমরা অন্ধের মত ছুটে চলেছি তার শেষ প্রান্তটি তো দেখতেই পাচ্ছি। যে ছাঁচে নিজেদেরকে ঢালাই করতে চলেছি, সে ছাঁচের মূর্তিটি তো সামনে দেদীপ্যমান। সেই জীবন সেই ছাঁচের মূর্তিরা তো আধুনিক জীবনের জীবনযন্ত্রণায় ছটফট করছে। তাদের পারিবারিক জীবন বিঘ্নে জর্জরিত। সমাজ খণ্ড, ছিন্ন, বিধ্বস্ত। সেখানে মানুষ ক্রমশই নিঃসঙ্গী হয়ে পড়ছে। স্নেহ, প্রেম, ভালবাসা, বিশ্বাস এসবে আর আস্থা নেই তাদের। তবু তারা সেই আধুনিকতার নেশায় আক্রান্ত হয়ে লক্ষ্যহীন ভাবে ছুটে চলেছে।
এ জন্য তো আজ জগতের সামনেই বিধৃত। তবু আমরা জেনে বুঝে সেই আত্মনাশা পথে পা বাড়াবো, একবার দাঁড়িয়ে পড়ে ভাবা দরকার। সেই দেখার মধ্য দিয়েই ধরা পড়বে আমাদের নিজেদের ভাঁড়ারে লক্ষ্মীর কৌটোয় অনন্ত ঐশ্বর্য।
নারীজীবনের পরম আদর্শ আমাদের ঘরের মধ্যেই মজুত। আমাদের ঘরে পরমাশক্তি স্বরূপিণী মা সারদাদেবী অভয় আশ্রয় নিয়ে বসে আছেন। যিনি একাধারে সংসারজীবনে অলৌকিক আদর্শ আবার ত্যাগী জীবনের পরমাশ্চর্য আদর্শ। তিনি রান্না করেন, কুটনো কোটেন, পান সাজেন, ব্যস্ত হাতে ভক্ত সন্তানদের জলখাবার গোছান। আবার অতি অনায়াসেই চরণ বাড়িয়ে মহাসন্ন্যাসী সন্তানদের পূজো গ্রহণ করেন ভগবতী মূর্তি নিয়ে।
মা সারদা কী কম আধুনিকা? কম সংস্কারমুক্ত? সেই শতাধিক বছর আগের একটি ঘোরতর সংস্কারবদ্ধ গ্রাম বাংলার মেয়ে হয়েও কী অনায়াসে বিদেশিনী মেয়ে নিবেদিতাকে গ্রহণ করেছিলেন। আমজাদের উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করেছিলেন। অবশ্য এ তার শক্তির একটি স্ফুলিঙ্গের দৃষ্টান্ত মাত্র। অতি সাধারণ একখানি ছদ্ম আবরণের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রেখে লোকশিক্ষা দিয়ে গেছেন। গেছেন বলাটি ভুল, তিনি তো আছেন, পরিব্যাপ্ত হয়ে দিয়ে চলেছেন। শুধু নিতে পারলেই হল।
ছদ্মবেশ না হলে চলবে কেন? আগুনকে যখন আলোর কাজে লাগানো হয়, তখন তাতে একটি কাঁচের আবরণ দিতে হয়। ভোলা আগুন সহ্য করবে কী করে মানুষ?
যেমন মাঠের মাঝখানে এক একটি বৃহৎ বিশাল বৃক্ষ থাকে ছায়া বিছিয়ে! রোদের মাঠে চলা তাপদগ্ধ পথিক এক একবার সেই ছায়ার নীচে বসে শরীর মন জুড়িয়ে নেয়। তেমনি এই জগৎসংসারে যুগদেবতারা যুগে যুগে মাঝে মাঝেই ছায়া বিছিয়ে বসে থাকেন। সংসার-তাপদগ্ধ মানুষ তার তলায় গিয়ে বসে স্নিগ্ধ হয়ে নেবে বলে।
দেহের বিলোপ ঘটে, আদর্শের বিলোপ ঘটে না। সেই আদর্শের রূপটিই যেন শরীরিণীমূর্তি হয়ে তাপিত পৃথিবীকে শীতল ছায়া দেবার জন্য চির অপেক্ষমাণ। মা সারদা একাল সেকাল চিরকাল আর প্রাচীন আধুনিক সকল আদর্শের মূর্তিমতীরূপ।
আজকের দুরন্ত আর অশান্ত মেয়েদের বোধ হয় একবার থমকে দাঁড়িয়ে এই শাস্তিস্বরূপার মূর্তিটিকে অনুধাবন করে দেখা দরকার।
আর রয়েছেন পুরুষোচিত বলবীর্য আর প্রচণ্ড শক্তির মূর্তি মহাসাধিকা শ্রীশ্রীগৌরীপুরী মাতা। তার তীব্র অধ্যাত্মপিপাসা অতি শৈশব থেকে কীভাবে তাকে অসম সাহসিনী করে পথে প্রান্তরে পাহাড়ে অরণ্যে নির্ভয়ে ঘুরিয়েছে, সে ইতিহাস যাঁদের জানা তারাই অনুভব করবেন নারীশক্তি কোথায় পৌঁছতে পারে। অদম্য মনোবল কী ভাবে একেবারে সহায়সম্বলহীনা একটি মেয়েকে পরম লক্ষ্যের পথে নিয়ে যেতে পারে।
শ্রীশ্রীগৌরীপুরী মাতার অত্যাশ্চর্য অলৌকিক জীবনবেদখানি অনুধাবন করে দেখতে পারলে আজকের পথভ্রান্ত মেয়েরা হয়তো পথের দিশা খুঁজে পাবে।
ভারতবর্ষে আদর্শ জীবনের জীবন গ্রন্থের অভাব নেই, অভাব শুধু সে আদর্শ গ্রহণ করবার মানসিকতা। মহৎকে মহৎ বলে আমরা বিগলিত হই, কিন্তু নিজেকে তার ধারে কাছেও নিয়ে যেতে চেষ্টা থাকে না। এই তো হাতের কাছে চোখের সামনে মূর্তিমতী সেবা মা টেরেসা। কজন মেয়ে তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এগিয়ে আসে?
আসলে আদর্শকে জীবনে গ্রহণ করবার প্রেরণার মনটি তৈরি করার মতও শিক্ষার দরকার। স্কুল কলেজের তথাকথিত উচ্চশিক্ষার অবকাশে এক একবার ছুটে চলে আসতে হবে মন তৈরির পাঠশালায়। যে পাঠশালা খোলা রয়েছে দিকে দিকে, ভর্তি হতে ফী লাগে না, মাইনেও গুনতে হয় না, শুধু একবার বেড়া ঠেলে ঢুকে পড়তে পারলেই হল। আসতে পারলেই শান্তির সন্ধান মিলবে।
বহিরঙ্গে কেবলমাত্র জড়বস্তুর ভার জমিয়ে তোলার নেশায় হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে চলতে চলতে, একটি বারের জন্যেও থমকে দাঁড়িয়ে ভাবতে পারলে ভালো হয়–অন্তরের অঙ্গনখানি ভরে তোলার মত কোথাও কিছু মেলে কিনা দেখি। আর এও মনে রাখা দরকার নারীশক্তি এক মহাশক্তি। নারী যেমন কল্যাণরূপিণী তেমনি আবার প্রলয়ঙ্করীও। আমার নিজের মধ্যেই এই উভয় শক্তিই বিদ্যমান; কোনটিকে জীবন রচনায় বেছে নেবো? আমি আমার প্রভু হব না দাস হব?
ভুলে গেলে চলবে না আমরা ভারতের নারী। হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যের কাছে। রয়েছে আমাদের দায়বদ্ধতা।