একথা সত্য যে জ্ঞানকে ত্যাগ করে অপজ্ঞানের পিছনে ছুটলে এই রকমই হয়। শুভ অশুভর পার্থক্য বোঝবার ক্ষমতা থাকে না। তা না হলে যে প্রথা বোধ হয় পৃথিবীর কোনো দেশে নেই সেই অতি ঘৃণ্য আর অতি লজ্জাকর প্রথা পণপ্রথার জমজমাটি কারবারে নিত্য শত শত মেয়ে সে প্রথার বলি হয়ে চলেছে।
আজকের শিক্ষায় দীক্ষায় অগ্রসর মেয়েরা এ বিষয়ে সচেতন কই? বললে ভুল হবে না প্রত্যক্ষে না হলেও পরোক্ষে তারাও এই জঘন্য প্রথাকে সমর্থনই করে আসছেন। মেয়েরাই যে মেয়েদের শত্রু এই নিষ্ঠুর সত্যটি কার অজানা? তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত মেয়েরাও অনায়াসে পণের দাবিতে সোচ্চার হয়।
প্রাচীন ভারতে কী পণপ্রথা ছিল? মেয়েরাই কী এমন মেয়েদের অনিষ্টকারী ছিল? গবেষণাকারীরা হয়তো আবিষ্কার করবেন কবে থেকে এদেশে এমন অশুভ প্রথার সৃষ্টি হয়েছে। পণপ্রথা নিয়ে এতটি বলার কারণ মনে হয় নারীজীবনের সব থেকে অপমানকর এই প্রথা। অথচ নারীসমাজ সে সম্বন্ধে সচেতন নয়।
শিক্ষার কথায় আসি, শিক্ষার ক্ষেত্রে শুধু বিদ্যালাভই হয়। অবশ্য ইহ-পৃথিবীতে ওই করে খেতে শেখাটাই সব থেকে জরুরি নারী পুরুষ নির্বিশেষেই। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বিহীন স্বাধীনতা তো সোনার পাথর বাটি। করে খাওয়ার বিদ্যাটি শেখা আগে দরকার। জগৎসংসারে টিকে থাকতে ওইটিই পায়ের তলার মাটি। কিন্তু সেইটিই কী শেষ কথা? তা হলে আর পশুপাখী কীটপতঙ্গের সঙ্গে মানুষ নামক প্রাণীটার তফাৎ কোথায়? এই খাওয়া পরা থাকায় গড়া জাগতিক জীবনটির ঊর্ধ্বে অদৃশ্য যে আর একটি জীবন আছে তার সন্ধান কে দেবে? সে সন্ধান দিতে পারে ওই উচ্চ বিদ্যা নয়। উচ্চ শিক্ষা যে শিক্ষা যথার্থই উচ্চ, এবং যথার্থই শিক্ষা।
কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে দেখি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তো আর সেই সত্যকার শিক্ষা নিয়ে মাথা ঘামায় না। সেখানে কর্মশিক্ষার আয়োজন যথেষ্ট পরিমাণে আছে, মর্মশিক্ষার কোনো আয়োজন নেই। নেই ছেলেমেয়েদের চরিত্রগঠনের শিক্ষা। তাদেরকে মানুষ করে তোলার শিক্ষা।
আগে একটি শিশু অন্ততঃ পাঁচ বছর বয়েস পর্যন্তও পরিবারপালিত হবার সুযোগ পেত। তাতে মানসিক উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে সহজাত ভাবেই তার জীবনে কিছুটা শিক্ষালাভের অবকাশ হত। কিন্তু এখন দুআড়াই বছরের শিশুটিকেই ভোরবেলা ঘুম থেকে তুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় স্কুলে। আর তার জীবন তখন থেকেই বইখাতার ভারে ভারাক্রান্ত।
দেশে শিক্ষাব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন দরকার। যদিও শিক্ষাদপ্তর ফালতু লোকের কথায় কান দেবে এমন আশার হেতু নেই। তবু অরণ্যেরোদন করতে ইচ্ছে হয়, দেশের এই লক্ষ লক্ষ ছেলে মেয়েগুলোকে এক একটি কমপিউটার বানিয়ে তোলবার চেষ্টা না করে তাদেরকে এক একটি পূর্ণ মানুষ করে তোলবার সাধনা করাটাই বোধ হয় দেশের দশের সমাজের এবং তার নিজের পক্ষেও হিতকারী। তাছাড়া অন্তত আমাদের দেশে মেয়ে এবং ছেলের মধ্যে শিক্ষাদানের ব্যবস্থায় কিছুটা পার্থক্য থাকা উচিত। সৃষ্টিকর্তা তো দুজনকে দুরকম করেই গড়েছেন। সংসারজীবনে শান্তি শৃঙ্খলা আর স্থিতাবস্থা রাখতে হলে মেয়েদেরকে অবশ্যই পেতে হবে কিছুটা ধৈর্য, সহ্য, ত্যাগ আর উদারতার শিক্ষা। এক একটি সংসার নিয়েই তো সমাজ।
দেশের বর্তমান শিক্ষা যদি দেশকে কেবলমাত্র কিছু করিৎকর্মা পুরুষ উপহার দেয়, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎটি নিয়ে ভাবতে হতে পারে। প্রাচীন ভারতের শিক্ষাতেও নারীর মধ্যে পুরুষোচিত গুণগুলির বিকাশের চিন্তা ছিল। আবার তার সঙ্গে সর্বাঙ্গ সম্পূর্ণ নারীর গুণগুলির বিকাশের চেষ্টা ছিল সমধিক। তেমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে চিন্তার দরকার আছে।
সত্যকার শিক্ষা কখনোই সেকেলে হয়ে বাতিল হবার নয়। মহাভারতের চরিত্র মহাভারতের শিক্ষা আজও সমান কার্যকরী। সত্যশিক্ষা যুগে যুগে কালে কালে যুগোপযোগী চেহারা নিয়ে সমাজজীবনের কাজে লাগে। সত্যকার শিক্ষা সত্যকার জ্ঞান খাঁটি সোনার মতই চির মূল্যবান। পিতামহীর সেকেলে অলঙ্কারের নক্সা ভেঙে নতুন নক্সায় অলঙ্কার গড়িয়ে নিলেও, সোনা তার মূল্য হারায় না।
আজকের যুগের মেয়েরা যদি প্রাচীন ভারতের জ্ঞান আর আধুনিক জগতের বিজ্ঞানকে সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে আত্মস্থ করতে পেরে ওঠে, এই দেশই হয়ে উঠবে জগতের পথপ্রদর্শক। সেই পরম জ্ঞান এখানে মজুত আছে। যদিও প্রাচীন জ্ঞান আর আধুনিক বিজ্ঞানের শিক্ষার আকাশ পাতাল তফাৎ। জ্ঞানের শিক্ষা যখন বলে ঈশ্বরই সকল কিছুর কারক, সর্ব নিয়ন্তা–আধুনিক বিজ্ঞানের শিক্ষা যে কথা এক খুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে বলে ঈশ্বর টিশ্বর বলে কিছু নেই। ওসব কবিকল্পনা। আসলে সব কিছুই নিজে নিজেই হয়ে চলেছে। নেচারই সব কিছুর কারক। বিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য সাফল্য শুভ আর অশুভ দুটো প্রচণ্ড শক্তিই মানুষের হাতে তুলে দিয়েছে। আরও দিয়ে চলেছে। প্রতি মুহূর্তেই তো নতুন নতুন আবিষ্কার। এখন মানুষের বিচার্য সে কোন শক্তিটিকে গ্রহণ করবে। শুভকে না অশুভকে। শ্রেয়কে না প্রেয়কে।
অথচ এই ভারতেরই পরম বাণী যা থেকে আমি অমৃতত্ব লাভ করতে পারবো না, তা নিয়ে কী করবো? কিন্তু সত্যিই কী ভারতের আত্মা থেকে সেই পরম বাণী চিরতরে লুপ্ত হয়ে গেছে? . হয়তো তা নয়। তা হতে পারে না। ভারতের আত্মা অবিনাশী। আজকের যে দৃশ্য দেখে আমরা বিচলিত হচ্ছি, আতঙ্কিত হচ্ছি সে দৃশ্য নিশ্চয়ই সাময়িক বিভ্রান্তির। পৃথিবী জুড়ে ভোগবাদের হাতছানি। যন্ত্রদানবের অসুর শক্তি এ বিভ্রান্তি এনে দিচ্ছে। অশুভ শক্তি শুভ শক্তিকে চিরতরে গ্রাস করতে পারে না। জগতে বিভ্রান্তি আসে বলেই সম্ভবামি যুগে যুগের প্রতিশ্রুতি মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছে।