আপন অন্তঃপুরে বসে ভারতের চিরন্তন ধর্মচেতনাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে ঘরোয়া পূজাপাঠ ব্রতপার্বণ ছোট ছোট মেয়েলি শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। বালিকা বয়স থেকেই ভারতীয় মেয়েরা ব্রত নিয়মের মধ্যে থেকে অধ্যাত্মজগতের আভাস অনুভব করতে শিখেছে। সেই সব পূজা অর্চনার নীতি নিয়ম মন্ত্রট যেমনই ছেলেমানুষী হোক তার থেকেই সেই বাল্যচিত্তেই শিক্ষা হয়েছে নিয়মনিষ্ঠার, শিক্ষা হয়েছে সংযমের, কৃচ্ছসাধনের। সে মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করেছে, কল্যাণী নারীরূপে। আবার কবির ভাষাতেই বলি– কুলদেবতার গৃহদেবতার গ্রামদেবতার বাহিয়া সিঁড়ি জগৎ সবিতা বিশ্বপিতার চরণে পরাণ যেত যে ভিড়ি। হ্যাঁ, ওই মেয়েলি ব্রত নিয়ম পূজা আর্চার মধ্য দিয়েই ভারতীয় মেয়ের হৃদয়ে ঈশ্বরের আসন পাতা হয়ে যেতো। কিন্তু ক্রমেও সে সব লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
আজকের ভারত তো তার চিরকালীন বিশ্বাস মূল্যবোধ সংস্কার সব কিছুকেই কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিয়ে আর ঝেড়ে ফেলে বিশ্বের দরবারে প্রায় নিঃস্বমূর্তিতে দাঁড়িয়ে তবু আজও এই হৃতসর্বস্ব চিত্তবিত্ত হারিয়ে ফেলা অনুকরণপ্রিয় ভারতের দিকেই সমগ্র বিশ্ব তাকিয়ে দেখে সসম্ভ্রম সমীহে অগাধ কৌতূহলে। ভারতীয় জীবনদর্শন প্রাচীন ভারতের গভীর চিন্তার ফসল তার ধ্যানের মন্ত্র তার দেবদেবীর রূপকল্পনা, বিশ্বের অনুসন্ধানী জনেদের কাছে এখনও একটি রুদ্ধদ্বার রহস্যলোক। তাই ভারত যখন আপন ঐতিহ্যকে কুসংস্কার বলে ছেঁড়া কাঁথার মত পরিত্যাগ করে পরমপুলকে অপরের পুরনো জামা গায়ে চড়াতে চাইছে, তখনই সমগ্র বিশ্বে ক্রমশই বেড়ে চলেছে ভারত-সন্ধানীর সংখ্যা।
তাদের কৌতূহলের কারণ তারা অনুভব করছে, ভারতবর্ষের আকাশে বাতাসে এক আশ্চর্য উচ্চস্তরের জীবনদর্শনের ধারা প্রবহমান। নিতান্ত নিরক্ষর চাষীবাসীর মধ্যেও রয়েছে উপলব্ধির একটি অমৃতলোক।
ভারতবর্ষের চিরকালীন আদর্শ ত্যাগ। বহিরঙ্গের ঐশ্বর্যের প্রতি দৃকপাতহীন ত্যাগী জীবনকে ভারতীয় মন চিরদিনই সমগ্র দৃষ্টিতে দেখে এসেছে, কিন্তু শুধুই কী ভারতবর্ষই, আজকের অতি ভোগবাদী পশ্চিমীদুনিয়াও কী একটি সত্যকার ত্যাগী জীবনকে সমীহের চোখে সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে দেখেন না; এটিই সকল মানুষের অন্তর্নিহিত সত্য। মজ্জায় মজ্জায় ভোগবাদ যাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে–আরও প্রাপ্তি আরও আহরণের নেশায়, সেও একটি ত্যাগী জীবনকে দেখলে মাথা নত করে। খোঁজ করতে চেষ্টা করে কোথায় নিহিত রয়েছে এই ত্যাগের শক্তি।
ভারতীয় নারী চিরদিনই ত্যাগের প্রতীক। অপরের জন্য আত্মবিলোপই তার ধর্ম। ক্রমশই সমাজমানসে পরিবর্তন ঘটছে। ভোগবন্দী পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে, আর বিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য সাফল্যে প্রযুক্তিবিদ্যার দান সুবিধাগুলির মোহে আজকের ভারতীয় নারী ভোগবাদের শিকার হয়ে চলেছে। পাশ্চাত্যের এই মোহময়ী প্রভাব বড় প্রবল। দুর্নিবার তার গতি। আজকের ভারতে নারী আর অবরোধের মধ্যে নেই।
আজকের ভারতীয় সমাজ নারীকে আপন ভাগ্য জয় করবার অধিকার দিয়েছে। এবং অনেক সুযোগ সুবিধা দিয়েছে বইকি। এখন আর মেয়েদের সামনে কোনও দরজাই বন্ধ নেই। নারী সমাজও অতি দ্রুতই বিদ্যায় পাণ্ডিত্যে কর্মক্ষমতায় এবং সর্ববিধ দক্ষতায়ই পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠে সমান তালে পা ফেলে চলেছে।
অবশ্য সংখ্যা হিসেবে মেয়েদের ওই অগ্রসরতার হিসাব মুষ্টিমেয়ই। সমাজের কোটি কোটি মেয়েই তো এখনও পিছনে পড়ে আছে অশিক্ষা কুশিক্ষা আর কুসংস্কারের বেড়াজালে আটকে। তবু যারা সুযোগ পেয়েছে এগিয়ে যাবার, তারা হেরে যায় নি। মাত্র একটি প্রজন্মেই যে কতটা এগনো সম্ভব, তা আজকের মেয়েরা দেখিয়ে দিচ্ছে।
এই তো সেদিনও একথা শোনা গেছে মেয়েরা বেশি লেখাপড়া শিখে করবে কী? তারা কী জজ ম্যাজিস্ট্রেট হবে? না অফিসে চাকরি করতে যাবে? এখন সেকথা হাস্যকর। যাক ওকথা তো এখন বাসী হয়ে গেছে। কিন্তু কথা হচ্ছে কেবলমাত্র পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারাই কী নারীজীবনের একমাত্র সার্থকতা? কেবলমাত্র বহিরঙ্গে আপন কেরিয়ার গড়ে তোলাটাই হবে তার শেষ লক্ষ্য?
মেয়েদের আজ একথা ভাববার দিন এসেছে। ভাবা দরকার তার সমস্ত প্রয়াস কি কেবল মাত্র পুরুষের মত হয়ে ওঠার জন্য?
দেশের প্রত্যাশা ছিল, দেশের মেয়েরা শিক্ষাদীক্ষার সম্যক সুযোগ পেলে অধঃপতিত সমাজকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করে তুলবে। প্রাচীন ভারতের জ্ঞান আর আধুনিক জগতের বিজ্ঞান এই উভয় শক্তির সমন্বয়ে ভারতনারী উজ্জ্বল মহিমায় বিকশিত হয়ে ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে পথ দেখাবে। কিন্তু কোথায় সেই সমন্বয় সাধনের চেষ্টা, প্রাচীন ভারতের জ্ঞানের শিক্ষাকে কুসংস্কার বলে ধুলোয় ফেলে দিয়ে আলোকপ্রাপ্তা মেয়েরা তো অন্ধের মত সেই আধুনিকতার দিকে ধাবিত হচ্ছে, যেখানে বিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য সাফল্য অবিরত যযাগান দিয়ে চলেছে বিলাসিতা আর আড়ম্বরের। তাই আধুনিক জীবনে প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে চাহিদা আর চাহিদা। ন্যায্য পথেই হোক আর অন্যায্য পথেই হোক সে চাহিদা মেটানোই চাই। কিন্তু এ চাহিদার কী শেষ আছে? শুধু ওই চাহিদার হাঁ-টি বোজাতে বেড়ে চলে অন্যায়, অসততা, দুর্নীতি। বেড়ে চলেছে। সর্বশুভগ্রাসী দুরন্ত লোভ। অথচ আধুনিকতা যে কুসংস্কারমুক্তই হয়েছে তাই বা বলা যায় কই? আজকের আধুনিক জীবন তো এখনও চিরকালীন গ্রাম্য কুসংস্কারের বেড়াজালেই বন্দী।