পড়তে-পড়তে কল্পনার চোখে ভেসে ওঠে, সেইকালের পরিপ্রেক্ষিতে, মা ভবতারিণীর মন্দির প্রাঙ্গণ। গঙ্গার ধারের সেইঘরে বারান্দায় এক জীবন্ত বিগ্রহ–জিজ্ঞাসু শ্রোতাদের সামনে অনর্গল বর্ষণ করে চলেছেন, অমৃতময়ী কথার ধারা। উপলক্ষ হয়তো সেই জিজ্ঞাসু ব্যক্তিরা, লক্ষ্য তো অনন্ত কালের পৃথিবী।
শ্রীশ্রীঠাকুরের তো অনন্ত ভাব, অনন্ত বৈচিত্র্য, তবু কেন জানি না মনে হয়–সেই কথামৃতবর্ষী মুখটি যেন একটু মধুর সূক্ষ্ম কৌতুক-হাস্যোদ্ভাসিত। যেন মানবচরিত্রের যাবতীয় দুর্বলতা তার কাছে কৌতুকের বিষয়। কথার ধারাস্রোতের মধ্যেও মাঝে মাঝেই ঝিলিক দিয়ে উঠছে সেই কৌতুকের কণা। ঝিলিক দিয়ে উঠছে–চোখের কোণায়, ঠোঁটের রেখায়। অথচ তার অন্তরালে রয়েছে গভীরতর বেদনার আভাস।
লোক না পোক, এই মন্তব্যটির মধ্যে যেমন রয়েছে মজার ভঙ্গি, তেমনি রয়েছে বেদনা। মানুষ শব্দটার প্রকৃত অর্থ যে, মান সম্পর্কে হুঁশ থাকা–এমন সহজ সরল ব্যাখ্যা আগে কবে শুনেছে লোকে?
সকলের জন্যে, সর্বসাধারণের জন্যে, ঠাকুর আশ্চর্য সহজ ভাষায় দিয়ে গেছেন সর্ববিধ শিক্ষা, সর্বোত্তম শিক্ষা। কিন্তু আপাতসহজ এই কথাগুলি কি সত্যিই সহজ? সেই আশ্চর্য সহজ কথাগুলিই তো আজ প্রবল প্রাণশক্তির জোরে বিশ্বময় ব্যাপ্ত হতে চলেছে। দিনে দিনে উন্মোচিত হচ্ছে তার সহজতার মোড়ক, উঘাটিত হচ্ছে গভীর ভিতরের গভীর অসীম অর্থ। মানবজীবনে যে-কোনও স্তরে, যে-কোনও অবস্থায়, আর যে-কোনও চিন্তায় যত প্রশ্ন উঠতে পারে–মনে হয় বোধহয় সেই সমস্ত প্রশ্নেরই উত্তর আছে এর মধ্যে।
এই উঘাটন তো আরোই হতে থাকবে, যুগে-যুগে আসবেন নতুন ব্যাখ্যাকার, দেশে-দেশে অনূদিত হবে, ব্যবসায়ীর ব্যবসায়িক প্রয়োজনে নয়, আগ্রহী মানুষের নিজস্ব প্রয়োজনে। এযুগ হয়তো এখনও সমুদ্রের তীরে বসে ঝিনুক কুড়োচ্ছ মাত্র।
এসব কথা বলা আমার পক্ষে ধৃষ্টতাই, কতটুকু জেনেছি, কতটুকু বুঝেছি? পৃথিবীকেই বা কতটা জানি? ঠাকুরের কথাতেই বলতে হয়–একসের ঘটিতে কি চারসের দুধ ধরে? একথা শুধু আমার নিজস্ব বিশ্বাসের ধারণা।
শ্রীরামকৃষ্ণ আমার কাছে বিশাল একটি জিজ্ঞাসার চিহ্ন। কে ইনি? ছদ্মবেশী স্বয়ং তিনিই? সম্ভবামি যুগে যুগের অঙ্গীকার পালনার্থে এ যুগের এই রূপ? তবে এ রূপটি বড় করুণাঘন। বিনাশের ব্যবস্থা নেই, শুধুই পরিত্রাণ। এই পরিত্রাণের মন্ত্র ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্যে সঞ্চিত থাকবে কাল থেকে কালান্তরে।
সমকাল কখনোই কোনও কিছুরই সম্পূর্ণ মূল্যায়ন করতে পারে না, বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় বিভ্রান্ত হয়। বিতর্কের ঝড় ওঠে, অথবা ঔদাসীন্যের নিথরতা দেখা যায়। বিজ্ঞানের আশ্চর্য আবিষ্কারগুলিও যেমন, জ্ঞানের পরমাশ্চর্য আবির্ভাবও তেমন, গ্রহণ করতে সময় লাগে, বুঝতে সময় লাগে। তাই শ্রীরামকৃষ্ণের সময়সীমার মধ্যে প্রবাহিত অসীম অপার কথামৃত, সাগরের অনেকখানিই অ-সঞ্চিত রয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে অনেক অমূল্য বাণী।
পরম শ্রদ্ধেয় পরম ভক্ত শ্ৰীম আপন নামটুকু পর্যন্ত আড়ালে রেখে ঠাকুরের লীলার শেষের কটি বছরের অমূল্য কথাগুলি লিপিবদ্ধ করে রেখে জগতের যে উপকার করে গেছেন, তার জন্য তিনি চিরকাল নমস্য হয়ে থাকবেন। আক্ষেপ হয়, যদি তিনি আরও আগে ঠাকুরের সান্নিধ্যে আসতেন।
তবে আবার ঠাকুরের কথার মধ্যেই সব আক্ষেপের সমাধান। অমৃত কলসী কলসী খেলেও যা, একফোঁটা খেলেও তা। অর্থাৎ ওই এক ফোঁটার মধ্যেই আছে অমরত্ব দানের শক্তি। অবশ্য খেতে হবে। ওই একফোঁটাটুকুও সত্যিকার নিষ্ঠার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু আমরা তো সব জ্ঞানপাপী। জানি, বুঝি, ইচ্ছেও আছে, তবু হয়েও ওঠে না। আমার জীবনে কথামৃত–এই প্রশ্নটি চিন্তা করতে গিয়ে নতুন করে এই সত্যটির মুখোমুখি হতে হল। তবু বলি–কথামৃত আমার বড় প্রিয় গ্রন্থ।