এই বইখানি দেখে কিছু কথা হয়। সমাগতারা সকলেই তো চোখ থাকতে অন্ধ নয়। একজন বললেন, দক্ষিণেশ্বরে রানী রাসমণির ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে নাকি তিনি এই পরমহংসের ঘর দেখেছেন। একজন বললেন, কোথায় নাকি তিনি পরমহংসের পরিবারকে দেখেছেন। (তখন ওই ভাবেই বলতে শুনেছি।) আর বাড়ির একজন আত্মীয়া গুরুজন সগর্বে ঘোষণা করলেন, এই শ্ৰীম আমাদের স্বজাতি। এমন কি শাখা-প্রশাখায় কিছু আত্মীয়তাও আবিষ্কার করলেন মনে হয়। হওয়া অসম্ভব নয়, গুপ্তদের সঙ্গে গুপ্তদের কিছু না কিছু যোগসূত্র থাকেই।
সে যাক, এত কথার পর প্রথমে কিন্তু অমিয় নিমাই চরিতই ধরা হল। সে আসরে মাঝে মাঝেই ধ্বনি উঠত, আহা! আহা! মধু! মধু!
তা পাঠিকারও বেশ আকর্ষণ লেগে গিয়েছিল। দুপুরটা গেল বলে আর আক্ষেপ আসত না।
অমিয় নিমাই চরিতের খণ্ডগুলি সাঙ্গ হবার পর ধরা হয়েছিল কথামৃত। শুরু হতেই আকর্ষণ। শ্রীরামকৃষ্ণের সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত, আর বিশেষ করে মা ভবতারিণীর মন্দির, আর মন্দিরসংলগ্ন পারিপার্শ্বিকতার নিখুঁত নিপুণ বর্ণনাটি যেন ছবির মত লাগে।
জন্মগৃহ উত্তর কলকাতার প্রায় শেষপ্রান্তে শ্যামবাজার অঞ্চলে, ছেলেবেলায় মা বাবা ভাই বোন মিলে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে যাওয়া হয়েছে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে, সে এক উত্তেজনাময় আনন্দের ভ্রমণ! (সে যুগে অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েদের জন্যে কীই-বা আয়োজন ছিল?)
কথামৃতের সূচনায় লিখিত বর্ণনার সঙ্গে-সঙ্গে তাই ছবিটি চোখের সামনে ফুটে উঠত। সেই প্রথম ঠাকুরের ঘরটি দেখে অতি বাল্যেও মনে হয়েছিল, যেন এইমাত্র ঘর ছেড়ে কোথাও উঠে গেছেন, এইমাত্র আসবেন। পরবর্তীকালে দীর্ঘ দিনই তো সেই রকমই ছিল। মাঝে অবশ্য অনেক দিনই যাওয়া হয় নি। কিছুদিন আগে দেখলাম, সে ঘরের মেঝে মোজাইকে মোড়া। কেন জানি না, ঘরের এই উন্নতি দেখে হঠাৎ বুকটা যেন খাঁ-খাঁ করে উঠেছিল, মনে হয়েছিল মস্তবড় কী একটা হারিয়ে গেল। মেঝের মাঝামাঝি জায়গায় একটুখানি লম্বা দাগবাজী করা লাল সিমেন্টের সেই মেঝেটি খুঁড়ে তুলে ফেলার সময় কারও মনে কোনও ক্ষতিবোধ এল না? মনে হয়েছিল, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদামণি, নরেন আর অসংখ্য ভক্তবৃন্দের পদধূলিস্পর্শে ধন্য সেই সিমেন্টের চাপড়াগুলি কি ফেলে দেওয়া হয়েছে? কোথাও রেখে দেওয়া হয় নি?
যাক ও কথা! (বয়স হলেই বোধহয় ভাবপ্রবণতা বাড়ে)। সেই অনেকদিন আগের কথাই বলি–পাঠের আসর যখন বেশ জমজমাটি, এবাড়ি ওবাড়ি থেকে দুপুরের গ্রাবু খেলার আড্ডা ভেঙে আরও দুচারজন মহিলার আবির্ভাব ঘটছে, সহসাই একদিন সেই আসর ভঙ্গ হয়ে গেল। কারণ, গ্রন্থগুলির মালিকানী ভক্তিমতী সেই মহিলাটিকে হঠাৎ সে পাড়া থেকে চলে যেতে হল। ভাড়াটে বাড়ি, বদল হল আর কি।
তিনি গেলেন, বইগুলিও তার সঙ্গে চলে গেল, কথামৃত তখনো শেষ হয় নি।
শ্ৰোত্রীদের মধ্যে হায় হায়! আহা দুপুরটা একটু ভালয় যাচ্ছিল। কী সব জ্ঞানগর্ভো কথা শুনছিলাম।
তবে ওই পর্যন্তই। সেই পাঠের আসর চালু রাখার প্রেরণা বিশেষ কেউ অনুভব করলেন না!
এদিকে পাঠিকার মধ্যে তুমুল হায় হায়। বইটা শেষ হল না। তাছাড়া মহিলা বলেছিলেন, যার কাছ থেকে বইটি এনেছিলেন, তার কাছে পরবর্তী আরও খণ্ড আছে।
এমন দাবি করব না যে, ধর্মকথার জন্যেই এত আগ্রহ আকুলতা। বইটা শেষ হল না, এটাই আক্ষেপের কারণ। তখনকার আমলে গেরস্থ ঘরের বৌ-টৌয়ের কোনও ব্যাপারেই ব্যাকুলতা প্রকাশের আইন ছিল না। এমন কি–মা-বাপের অসুখ করেছে শুনলেও নীরবে অপেক্ষা করতে হত, ওপরওলাদের বিবেচনার উদারতা কতটা তা দেখতে।
তবে পাড়ার একটা লাইব্রেরীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, কিছুদিন চেষ্টা চালানোর চেষ্টা করলাম, সেখান থেকে পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু বারে বারে খোঁজ করিয়েও মিলল না। আর অস্বীকার করব না, ক্রমশ আগ্রহটাও কমতে কমতে থেমে গেল। লাইব্রেরীতে গল্প উপন্যাসের তো অভাব নেই। তা ছাড়া–যদিও তখন নেহাতই শিশুসাথী, খোকাখুকুর লেখিকা, তবু তার তাগাদা আছে–আছে মনের মধ্যেও তাগিদ।
সে যাক, সেই আমার কথামৃতের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। তারপর জীবনের অনেকখানি পথ পার হয়ে প্রথম দ্বিতীয় দুটি খণ্ড হাতে এল। বিশেষ একটি বিষণ্ণতার দিনে একজন উপহার দিয়ে গেল। পড়লাম পরম আগ্রহে। জ্ঞানাবধি রবীন্দ্রনাথকেই জীবনের পরম আশ্রয় ভেবে এসেছি। দেখলাম, তেমন আশ্রয় এখানেও বিদ্যমান।
পড়তে দারুণ ভালবাসি, পড়াই প্রাণ, তবু বিধিবদ্ধভাবে নিয়ম করে কখনোই কিছু পড়বার সুযোগ ঘটে নি। না বা পড়ায়, না লেখায়। সাংসারিক জীবনের রোগ শোক সুখ দুঃখ, অভাব অসুবিধে, সবকিছুর মধ্যে থেকে এলোমেলো ভাবে লেখা, আর এলোমেলো ভাবে পড়া হয়েছে। আর লেখাটা বাড়তে বাড়তে-পড়াটাকে প্রায় কোণঠাসা করে রেখেছে।
কত বইই পড়বো বলে সরিয়ে-সরিয়ে রাখি পড়ার জন্যে, আর সময় বার করা যায় না; জীবনের শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি। তবু কোনও কিছুই নিত্যপাঠের অভ্যাস বজায় রাখতে পারা যায় না। একবার পড়ে শেষ করে ফেলার বস্তু তো নয়?
শেষ নাহি যার, শেষ তারে কে করবে?
তবু যখনই পড়ি সমান ভালো লাগে। যেন নতুন লাগে, নতুন করে ভালো লাগে। দুঃখের দিনে, বেদনার দিনে, ক্ষতির দিনে, শরণ নিতে ইচ্ছে হয়।