বাঙালি ভাবপ্রবণ ও কল্পনাপ্রিয়। উচ্ছ্বাস ও উত্তেজনাতেই এর প্রকাশ। তাই বাঙালি যখন কাঁদে তখন কেঁদে ভাসায়। আর যখন হাসে তখন সে দাঁত বের করেই হাসে। যখন উত্তেজিত হয় তখন আগুন জ্বালায়। তার সবকিছুই মাত্রাতিরিক্ত। তার অনুভূতি-ফলে অভিভূতি–গভীর। কেঁদে ভাসানো, হেসে লুটানো আর আগুন জ্বালানো আছে বটে কিন্তু কোনোটাই দীর্ঘস্থায়ী নয় যেহেতু উচ্ছ্বাস-উত্তেজনা মাত্রেই তাৎক্ষণিক ও ক্ষণজীবী। বাঙালির গীতিপ্রবণতার উৎস এখানেই।
কালো পিঁপড়ের মতো বাঙালি অতিচালাক। তাই সে ধূর্ততা যত জানে সুবুদ্ধির সুপ্রয়োগ তত জানে না, ফলে আত্মরক্ষা ও স্বার্থপরতার হীন প্রয়োগে তার তীক্ষ্ণবুদ্ধি কলুষিত হয়, আত্মপ্রতিষ্ঠার মহৎ প্রয়াসে প্রযুক্ত হয় না। তাই তার সঙ্শক্তি নেই ব্যবহারিক জীবনের উন্নয়নে বুদ্ধির অবদান গ্রহণে সে অক্ষম।
ভাবপ্রবণ বলেই বাঙালি মুখে আদর্শবাদী ও বৈরাগধর্মী। কিন্তু প্রবৃত্তিতে সে একান্তভাবে অধ্যাত্মবাদীর ভাষায় বস্তুবাদী গণভাষায় জীবনবাদী এবং নীতিবিদের ভাষায় ভোগবাদী। এজন্যে বাঙলাদেশে জীবনবাদ বা ভোগবাদ অধ্যাত্মচিন্তার উপর বারবার জয়ী হয়েছে। নৈরাত্ম ও নিরীশ্বরবাদী এবং নির্বাণকামী বৌদ্ধধর্ম বাঙালি মুখে স্বীকার করে নিয়েছিল মাত্র, সেজন্যেই তার অন্তরের জীবনসাধনা ধর্মের উপর জয়ী হল তাই বৌদ্ধচৈত্য হল দেব-দেবীর আখড়া। নির্বাণের নয়—-জীবনের ও জীবিকার আরাম ও বিলাসের দেবতারূপে পূজিত হলেন তারা। পারত্রিক নির্বাণ নয়, ঐহিক ভোগই হল কাম্য। যেহেতু বাঙালি কর্মকুণ্ঠ তাই পৌরুষের দ্বারা আত্মপ্রতিষ্ঠা বা জীবনোপভোগের প্রয়াস তাদের ছিল না। মহাজ্ঞান, তুকতাক, ডাকিনীযযাগিনী প্রভৃতির দ্বারা সিসম ফাঁক আয়ত্ত করে খিড়কিদ্বার দিয়ে জীবনের ভোগ্যসম্পদ আহরণের অপপ্রয়াসই তাদের কর্মাদর্শ বা জীবনের লক্ষ্য হল। পালদের আমল এমনি করেই কাটল। আবার সেন আমলে যখন শঙ্করাচার্যের শিষ্য উপশিষ্যেরা সেন-রাজশক্তির সহায়তায় এদেশে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম প্রবর্তন করেন তখন বাঙালি বাহ্যত ব্রাহ্মণ্য মতবাদ গ্রহণ করে নিল কিন্তু হৃদয়ে জিইয়ে রাখল তার জীবন-বিলাসের আকাঙ্ক্ষা। তাই মায়াবাদ পরব্রহ্মপ্রীতি, জীবাত্মা, পরমাত্মার রহস্য প্রভৃতিতে তার কোনো উৎসাহ ছিল না। শুধু তাই নয়, এতে সে হাঁপিয়ে উঠেছিল। তাই নিজের জীবনের নিরাপত্তা ও ভোগের দেবতা সৃষ্টি করে সে আশ্বস্ত হয়। এভাবে চণ্ডী (অন্নদা, দুর্গা), মনসা, শীতলা, ষষ্ঠী, শনি, লক্ষ্মী, সরস্বতী প্রভৃতি দেবতার পূজা দিয়ে সে জীবন ও জীবিকার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়। এসব দেবতা তার পারলৌকিক মুক্তির কিংবা আত্মিক বা আধ্যাত্মিক জীবন উন্নয়নের কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন না। একই কারণে ইসলামোত্তর যুগে বিশেষত মুঘল আমলে বাঙলা দেশে হিন্দুর পুরোনো দেবতাকে ও ইসলামের নির্দেশকে ছাপিয়ে উঠেন সত্যপীর-সত্যনারায়ণ, বনবিবি-বনদেবী, কালুগাজী-কালুরায়, বড়খা গাজী-দক্ষিণ রায়, ওলাবিবি-শীতলা প্রভৃতি জীবন ও জীবিকার ইষ্ট দেবতা। অতএব কোনো বৃহৎ ও মহতের সাধনা সাধারণ বাঙালির কোনোকালেই ছিল না। সে একান্তভাবে জীবনসেবী ও ভোগবাদী। এ ব্যাপারে সে আত্মা-পরমাত্মাকে তুচ্ছ জেনেছে,স্বর্গ-নরককে করেছে অবহেলা। বৈষ্ণব সমাজের বিকৃতিও এই একই মানসের ফল। যেখানেই সে ভোগের সামগ্রী দেখেছে, সেখানে তার লুব্ধচিত্ত কাঙাল হয়েছে। পৌরুষ তার ছিল না। ভীরুতা ও কর্মকুণ্ঠা তার মজ্জাগত। তাই জীবন ধারণের প্রয়োজনে দেব-নির্ভর তথা অপ্রাকৃত ও অতিপ্রাকৃত শক্তি ও উপায় খোঁজাই ছিল তার আদর্শ। তবে লোভের তীব্রতায় এবং ত্রস্ত জীবনের মমতায় কখনো কখনো সে ক্ষণকালের জন্যে মরিয়া হয়ে বিরুদ্ধশক্তির সঙ্গে দ্বন্দ্বে নেমেছে, সে সাহস দেখিয়েছে। কিন্তু জৈব-ধর্মবিরোধী নির্জলা অধ্যাত্মচিন্তা তাকে প্রলুব্ধ করেনি। সে আদর্শবাদের বন্ধনভীরু এবং জীবন-সাধনায় ও ভোগে অদম্য।
বাঙলার বাঙালির যা গৌরব-গর্বের অবদান, তা সব সময়েই ছিল ব্যক্তিক অবদান, সামগ্রিক জীবনে তা কৃচিৎ ফলপ্রসূ হয়েছে তাই। বাঙালি মহৎ পুরুষদের মহা অবদানের ফলভোগে ধন্য হতে পারেনি তারা। এই বাঙলা দেশেই চিরকাল নতুন চিন্তা জন্ম নিয়েছে। কিন্তু লালন পেয়েছে সামান্য। তবু যখন আমরা স্মরণ করি এই মাটির বুকেই এই মানুষের মনোভূমেই উপ্ত হয়েছিল বজ্রযান সহজযান, কালচক্রযান, কায়াবাদ, নবন্যায় নবস্মৃতি, নবপ্রেমবাদ ওহাবী-ফরায়েজী মতবাদ কিংবা ব্রাহ্মদর্শন; তখন গর্বে আমাদের বুক ফুলে উঠে। আবার যখন স্মরণ করি মীননাথ, গোরক্ষনাথ, দীপঙ্কর, শীলভদ্র, জীমূতবাহন রামনাথ রঘুনাথ চৈতন্যদেব রামমোহন ঈশ্বরচন্দ্র তীতুমীর শরীয়তুল্লাহ দুদু মিয়া রবীন্দ্রনাথ নজরুল এদেশেরই সন্তান; তখনো নতুন করে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই।
আমাদের মধ্যযুগীয় পাঁচালি সাহিত্যে বাঙালির এই চারিত্র– এই মানসই ফুটে উঠেছে। আমাদের সাহিত্যে তাই ইষ্টদেবতাই প্রধান হয়ে উঠেছে। কারণ তিনি জীবন-জীবিকার অবলম্বন। তবু তার প্রাণপ্রাচুর্যের লক্ষণ ফুটে উঠেছে তার স্বধর্মে সুস্থিরতায়। বহিরাগত কোনো ধর্মই সে মনেপ্রাণে বরণ করে নেয়নি। এ স্বাতন্ত্র্য ও অনমনীয়তা একালে ক্ষেত্রবিশেষে তার মর্যাদা বাড়িয়েছে।
বিদ্যা ও বিশ্বাস
বিদ্বানেরা বলেন, আদিতে মানুষ ছিল অরণ্যচর ও পর্বতবাসী। ফল, মূল ও মাংস ছিল তাদের খাদ্য। ক্রমে তাদের বুদ্ধির বিকাশ হয়। বুদ্ধি ও কর্মশক্তির প্রয়োগে মানুষ জীবিকা-পদ্ধতির উন্নয়ন, খাদ্যবস্তুর উৎকর্ষ এবং নিবাসের রূপান্তর সাধন করে।