এই দেশে কৃষক শ্রেণীর রাজনীতির একটা গৌরবজনক ঐতিহ্য ছিলো। শ্রমিক শ্রেণীর রাজনীতিরও বেগবান একটা ধারা ছিলো। অতীতে ক্ষমতার পালাবদলে তারা বড়ো বড়ো ভূমিকা পালন করেছেন। এই দেশেরে অন্যূন সত্তর শতাংশ মানুষ কৃষক। জনসংখ্যার বিচারে জাতীয় রাজনীতিতে তাদের কোনো ভূমিকার কথা দূরে থাকুক, সক্রিয় উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায় না। বেবাক রাজনীতি নিলামে কেনা পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষক শ্রমিক নির্যাতিত জনগোষ্ঠী তাদের পছন্দ মতো প্রতিনিধি সংসদে পাঠানোর কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। যারা চড়া দাম দিয়ে ভোট কিনে নিতে পারে, যারা গুণ্ডা এবং মাস্তান লাগিয়ে পুলিং বুথ দখল করে নিতে পারে, নির্বাচনে তারাই অনিবার্যভাবে জয়লাভ করে। কৃষক এবং নির্যাতিত মানুষ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে ভোট দিয়ে থাকেন। ভোট দিতে বিরত থাকলেও তাদের ভোট আকাশ থেকে ফেরেশতা এসে দিয়ে যায়। দরিদ্র মানুষেরা ভোট দিতে পারেন কিন্তু নিজেদের মনোনীত ব্যক্তিকে নির্বাচিত করে সংসদে পাঠাবার অধিকার তাদের নেই। আগুনের ছবি আগুনের মতো দেখালেও তার দাহিকাশক্তি থাকে না। বাংলাদেশে বর্তমানে যে গণতন্ত্র চালু আছে, সেই জিনিশটি তৃণমূল থেকে উঠে আসেনি। পশ্চিমা শক্তিগুলো দুনিয়া জোড়া গণতন্ত্রের খবরদারীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, তারাই এখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি চালু রেখেছে। কমিউনিজমের পতনের আগে তারা সেনা ছাউনির ওপর নির্ভর করতো। হালফিল তাদের গণতন্ত্রের চর্চার ওপর অত্যধিক জোর প্রয়োগ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
বাংলাদেশে যে গণতন্ত্র চালু আছে সেটা যে গণতন্ত্রের প্রহসন, পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিম বাংলার সঙ্গে তুলনা করলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। বিগত রাজ্যসভা নির্বাচনে কালু ডোম নামে বর্ধমান জেলার এক প্রার্থী সর্বভারতে পরিচিত এক কংগ্রেস প্রার্থীকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন। কালু ডোম নামটিতেই তার পেশাগত পরিচয় পাওয়া যায়। এরকম বাংলাদেশে কল্পনা করাও কি সম্ভব? পেশাজীবী মানুষ তাদের মনোমতো প্রতিনিধিকে সংসদে পাঠাবার কথা কি চিন্তাও করতে পারেন? বাংলাদেশের সংসদে নানা দল থেকে যে সকল সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন, তার শতকরা ষাট ভাগই স্থায়ীভাবে ঢাকা এবং বিশ ভাগ জেলা সদরে বসবাস করেন। তাঁদের শরীরে শ্রমঘামের কোনো গন্ধ নেই। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আশা আকাঙ্খর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশে যে গণতন্ত্রটি চালু আছে তার মাধ্যমে আসল জনগণের শত্রুরা নির্বাচনে জিতে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর বুকের ওপর সওয়ার হয়ে রক্ত শোষণ করার আইনগত বৈধতাই অর্জন করে।
ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনের লড়াইয়ে জেতার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে এলে দলে দলে যে দলটি জিতবে তার পক্ষপুটে আশ্রয় গ্রহণ করে। দেখা যাবে আজকে যে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচনে লড়ছে, গত নির্বাচনে সে একই ব্যক্তি জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলো। জাতীয়তাবাদী দল থেকে জাতীয় পার্টিতে যাওয়া, জাতীয় পার্টি থেকে আওয়ামী লীগে আসা এগুলো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় রাজনীতিতে আদর্শবাদের ক্ষীণতম ছোঁয়াটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। রাজনৈতিক সুবিধাবাদই গোটা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের নিয়ামক শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থটাই সেখানে প্রধান। দেশের জনগণের ভালো মন্দের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য কৃষক শ্রমিক ব্যাপক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের প্রয়োজন হয় না। এ থেকে প্রমাণিত হয় গণতন্ত্রের শেকড় এখানে কতো দুর্বল। শুধু ছাত্ররা একটি সরকারের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক জনগোষ্ঠীর অংশ গ্রহণ ছাড়াই শুধুমাত্র আমলা এবং এনজিও কর্তারা আরেকটি পতন ঘটাতে পেছপা হবে না।
মুৎসুদ্দি শ্রেণীর হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি থাকায় গণতন্ত্র এখানে প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করতে পারছে না। সমাজের তৃণমূল অবধি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রসারিত হতে পারছে না। এই মুৎসুদ্দি শ্রেণী অনড় অটল হয়ে সমাজের পথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের প্রভাব খর্ব করতে না পারলে যে কোনো ধরনের ইতিবাচক রাজনৈতিক উত্তরণের আশা সুদূর পরাহত থেকে যাবে।
.
০৫.
বাঙালী সংস্কৃতি থেকে প্রাণরস আহরণ করে জাতীয়তার বোধটি পুষ্ট এবং বিকশিত হয়েছে। তথাপি বাংলাদেশের সংস্কৃতির আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। কতিপয় জটিল সংকট সংস্কৃতি চর্চার পথটিকে কন্টকাকীর্ণ করে রেখেছে। বাংলাদেশের সংখ্যাধিক জনগণের মানস সংকটেরই প্রতিফলন ঘটছে সংস্কৃতিতে।
বাংলাদেশ নামে যে ভূখণ্ডটিতে আমাদের বসবাস, পঁচিশ বছর আগে সেই দেশটি ধর্মতান্ত্রিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ ছিলো। তারও আগে দেশটি পশ্চিম বাংলার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সংযুক্ত ছিলো। বৃটিশ শাসনের অন্যূন দুশো বছর কাল সময় বাংলা প্রদেশ বৃটিশ ভারতের একটি স্বতন্ত্র শাসন ইউনিট হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিলো। বৃটিশ বিদায়ের প্রাক মুহূর্তে ভারতের হিন্দু এবং মুসলমান একটি সংযুক্ত রাষ্ট্রে বসবাস করতে সম্মত হয়নি বলেই বৃটিশ-ভারতকে ভারত এবং পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করতে হয়েছে। বাংলা প্রদেশের হিন্দু মুসলমান নেতৃবৃন্দের একাংশ বাংলার ভাঙ্গন ঠেকাবার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি। সর্বভারতীয় রাজনীতির প্রবল টান অগ্রাহ্য করে বাংলা তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রক্ষা করতে সক্ষম হয়নি। হিন্দুপ্রধান পশ্চিমবঙ্গ ভারত ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে এবং মুসলিম প্রধান পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল হিসেবে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রিক অস্তিত্বের মধ্যেই অবস্থান তৈরি করেছে। পাকিস্তান ঘোষিতভাবেই ছিলো ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র। পাকিস্তান সৃষ্টির অল্পকালের মধ্যেই পূর্বাঞ্চলের লোকদের বোধোদয় হতে থাকে যে ধর্মতান্ত্রিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অধিকার কিছুই সুনিশ্চিত নয়। উনিশশো বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সর্বপ্রথম তাঁদের সংগঠিত প্রতিবাদটি জন্ম নেয়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানী জাতীয়তার বোধটি খারিজ করে বাঙালী জাতীয়তার বোধটি আঁকড়ে ধরে অগ্রসর হতে আরম্ভ করে। এই অগ্রযাত্রার পথটি সরল এবং একরৈখিক নিশ্চয়ই ছিলো না। অনেক দ্বিধা এবং দোদুল্যমানতা তাতে ছিলো। শেষ পর্যন্ত উনিশশো একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয়তার সগ্রাম এই পর্যায়ে একটা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।