সমাজতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদনের উপকরণসমূহের ওপর ব্যক্তি মালিকানার দখল থাকে না, সেগুলো সামাজিক মালিকানার ওপর ছেড়ে দিতে হয়। বাংলাদেশে উল্লেখ করার মতো বৃহদায়তন শিল্প কারখানা ছিলো না, যেগুলোও বা ছিলো, মালিক ছিলো অবাঙালী পশ্চিমা পুঁজিপতিরা। তারা দেশ ছেড়ে কলকারখানা ফেলে পাকিস্তানে চলে গেছেন। উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখার জন্য বাধ্য হয়েই সরকারকে এই শিল্পকারখানাসমূহের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়। শেখ সাহেব অনুপস্থিত পশ্চিমা মালিকদের শিল্পকারখানা অধিগ্রহণের কর্মটিকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ বলে ঘোষণা দিলেন। বিষয়টির ব্যাপকতা প্রমাণ করার জন্য বাঙালী মালিকের কিছু কিছু কলকারখানার দায়িত্বও সরকার গ্রহণ করলেন। আওয়ামী লীগ সরকার দলীয়ভাবে বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে এই সমস্ত কলকারখানার দায়িত্ব নিয়োজিত করলেন। রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা ছাড়া তাদের শিল্পকারখানা চালানোর কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা কিংবা যোগ্যতার বালাই ছিলো না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিরা শিল্পকারখানার মধ্যে কোনো রকম শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার বদলে অধিকতররা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করলেন। তাদের নামে অভিযোগ উত্থাপিত হতে আরম্ভ হলো, তারা কারখানার যন্ত্রাংশ বেঁচে দিচ্ছেন, কাঁচামাল পাচার করে ফেলছেন। তার নীট ফল এই দাঁড়ালো যে উৎপাদন কিছুতেই পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলো না। কোথাও পরিচালনার ক্রটিতে, কোথাও কাঁচামালের অভাবে কল কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে আরম্ভ করলো। রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে অর্থ ধার করে শ্রমিকদের মাইনে মাসের পর মাস পরিশোধ করতে হলো। এই সময়টা ছিলো শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সরকারের জন্য কঠোর অগ্নিপরীক্ষার কাল। আওয়ামী লীগ সরকার অনুপস্থিত মালিকদের শিল্পকারখানা অধিগ্রহণ করেছেন, না করেও উপায় ছিলো না। কিন্তু এই ব্যবস্থাটাকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ বলে ঘোষণা করে অর্থনৈতিক নৈরাজ্যের সবগুলো অর্গল খুলে দেয়া হলো। সত্য বটে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার দল আওয়ামী লীগের পক্ষে সমাজতন্ত্রের দাবী উপেক্ষা করে একটা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির পন্থা কবুল করে নেওয়া একটুখানি ঝুঁকির কাজ হতো। তারপরেও লুটপাট দুর্নীতি বন্ধ করে একটি স্বচ্ছ ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করা তাঁর পক্ষে অসভব হতো না। তিনি ভুল পথ অনুসরণ করলেন। কোনো রকমের সহায়ক ভিত্তি না থাকা সত্বেও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেন। সমাজতন্ত্র তো প্রতিষ্ঠা করা গেলো না। তৈরি করে ফেলেন একটা নৈরাজ্যতন্ত্র। জাতীয় অর্থনীতির মধ্যে যে ধরনেরই হোক একটা শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা না গেলে, অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা এবং নৈরাজ্য আসতে বাধ্য। জাতীয় অর্থনীতির মধ্যে একটা শৃঙ্খলা সৃষ্টি না হলে অর্থনৈতিক জীবন বিপর্যস্থ হয়ে পড়ে। সমাজে কালোবাজারী, মুনাফাখখারী, চোরাচালানী ইত্যাকার যতো ধরনের সামাজিক অপরাধ আছে সবগুলো প্রাধান্য বিস্তার করে জাতীয় অর্থনীতির টুটি চেপে ধরে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে দেখা গেলো সারা দেশে একটা লুটপাটের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, লাইসেন্স পারমিট সংগ্রহ করার বেলায় রাজনৈতিক ক্ষমতার বিস্তর অপব্যবহার হতে থাকলো। সরকারী ছত্রচ্ছায়ায় একদল মানুষ রাতারাতি অঢেল টাকার মালিক হয়ে উঠলেন। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ তাঁরা কেউ স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা বাণিজ্য কিংবা শিল্প কারখানার মাধ্যমে আয় করেন নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে এই অঞ্চলে মাত্র একজন কোটিপতির অস্তিত্ব ছিলো। বর্তমানে কোটিপতির সংখ্যা হাজার হাজার। একটি ছোটো দরিদ্র দেশে এই পরিমাণ ধনিকের উত্থান, সেটা নির্লজ্জ লুণ্ঠনের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে। কি পরিমাণ লুণ্ঠনের সুযোগ পেলে মাত্র বিশ হাজার টাকার পরিমাণ সম্পদের মালিক একশো কোটি টাকার মালিক হতে পারে, বাংলাদেশ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
শেখ মুজিবুর রহমানের রাজত্বকালে এই কোটিপতিদের জন্ম। জিয়াউর রহমান তাঁদের লালন করেছেন এবং বাড়িয়ে তুলেছেন। এরশাদ সমাজ জীবনে তাদের আইনগত বৈধতা দিয়েছেন। হাল আমল পর্যন্ত এসে তারা গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রটা তাঁদের কব্জার মধ্যে এনে ফেলেছেন। তাঁদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন ছাড়া কোনো সরকার টিকে থাকতে পারে না। তাদের সক্রিয় মদদ ছাড়া কোনো দল সরকার গঠন করতে পারে না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ছোটোখাটো দলের সভা কিংবা শোভাযাত্রার জন্যও তাঁদের চাঁদার ওপর নির্ভর করতে হয়।
আমাদের সমাজে এই নব্য নবাবেরা অঢেল টাকার মালিক। ভোগ উপভোগের সমস্ত উপকরণ তাদের এখতিয়ারে। কিন্তু জাতীয় বুর্জোয়া তাদের কিছুতেই বলা যাবে না। বুর্জোয়া চরিত্রের মধ্যে অন্য অনেক দোষ যাই থাকুক তাদের সেন্স অব বিলঙ্গিং অর্থাৎ এটা আমার নিজের জাতি, এই জাতির উন্নতি অবনতির সঙ্গে সরাসরি আমার ভাগ্যও জড়িত, এই বোধ তাদের নেই। আমাদের দেশে যে সকল মানুষ হঠাৎ ধনী হয়ে উঠেছে জাতীয় বুর্জোয়াদের অঙ্গীকার তাদের কাছ থেকে আশা করা দূরাশার শামিল। মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলাই তাদের একমাত্র অভীষ্ট। আমাদের জাতীয় মধ্যশ্রেণীটি দু’ভাবে দেশের মানুষকে শোষণ করে। একদিকে দেশে উৎপাদিত কাঁচামাল বিদেশে রপ্তানি করে দেশের মানুষকে শোষণ করে। অন্যদিকে বিদেশের উৎপন্ন পণ্য দেশে আমদানী করে একইভাবে শোষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে। দেশের চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে কলকারখানার প্রতিষ্ঠা করে জাতিকে স্বনির্ভর এবং বেকার জনগণের কর্মসংস্থানের কোনো দায়িত্ব তারা আদৌ বোধ করে না। তাদের বিকাশ আমাদের জাতীয় জীবনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। একটি সুড়ঙ্গ পথের ভেতর দিয়ে হেঁটে জাতির শিরোভাগে অবস্থান গ্রহণ করে তারা জাতির অগ্রগতির পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে। এই জাতীয় টাকাঅলা মানুষেরা যদি সত্যিকার অর্থে জাতীয় বুর্জোয়ার স্থান দখল করতে পারতো, একদিক থেকে দেশের জন্য সেটা মঙ্গলকর হতো। বুর্জোয়ারা রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান গ্রহণ করতে এটা ঠিক, কিন্তু সমান্তরালে কৃষক, শ্রমিক এবং নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর রাজনীতি আপনিই বিকশিত হয়ে উঠতো। জাতীয় মধ্যশ্রেণীভূক্ত এই সমস্ত মানুষ বাংলাদেশের রাজনীতির মেরুকরণ ঠেকিয়ে রেখেছে। এই কাঠামোহীন অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে যে বুদ্ধিজীবী শ্ৰেণীটি নতুন রাষ্ট্রযন্ত্রের নাটবল্ট ঘোরাবার দায়িত্ব পেয়ে গিয়েছিলেন, দ্রুত ধনী হওয়ার মানসিকতা তাঁদেরও চরিত্রলক্ষণ হয়ে দাঁড়ালো। পরোক্ষে তারাও লুণ্ঠণের অর্থনীতির ফায়দা তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সরকারী আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবীসহ সাদা পোষাকের পেশাজীবীদের বেশিরভাগেরই চরিত্র থেকে মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা একেবারেই বিদায় নিলো। এই ধরনের একটি লোভ লাভের সার্বিক পরিস্থিতিতে বুদ্ধিজীবীরা কখনো ঋজু শিরদাঁড়ার অধিকারী হতে পারেন না। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা যে বেশিরভাগ চরিত্রভ্রষ্ট তার মূল কারণ লুণ্ঠণের অর্থনীতির মধ্যেই নিহিত।