‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ লেখাটির একটি বিশেষ পর্যায়ে প্রান্তিক জাতিসমূহের ওপর যে নির্যাতন নিপীড়ন চলে আসছে তার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আমি হাজির করেছিলাম। সাম্প্রতিক বিবেচনা যখন তৈরি করছি উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সগ্রাম একদিকে যেমন একটি দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধের আকার পেয়েছে, তেমনি অন্যদিকে শক্তিশালী প্রতিবেশীর আগ্রাসী তৎপরতার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। শুরুতে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার স্বীকার না করার মনোভাব থেকেই এই সঙ্কটের জন্ম হয়েছে। আসলে আমাদের নিপীড়িত জনগণের জীবনের যে মূল সঙ্কট, উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্কট তার চাইতে খুব একটা বিচ্ছিন্ন নয়। তাদের বিশেষ বিশেষ অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতিদানের মাধ্যমে তাঁদের আস্থা অর্জন করার এখনই প্রকৃষ্ট সময়। বিলম্বে অনর্থপাত ঘটে যেতে পারে।
.
০৪.
অর্থনীতি রাজনীতির মূল চালিকা শক্তি। রাজনীতির চেহারাটি কি দাঁড়াবে নেপথ্যে অর্থনীতিই নির্ধারণ করে দেয়। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির দিকচিহ্নহীনতা এবং গণবিরোধী চরিত্র সেটাকে বাংলাদেশের অচলবন্ধ্যা অর্থনীতির যথার্থ প্রতিফলন বললে খুব বেশি বলা হয় না। অনড় স্থবির গতিহীন অর্থনীতিই রাজনীতিতে ক্রমাগত সংঘাত ডেকে আনছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এমন একটা দুষ্টচক্রের মধ্যে আটকা পড়ে আছে, সেখান থেকে উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা পরিদৃশ্যমান নয়।
বাংলাদেশের জনগণ মূখ্যতঃ অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করার তাগিদেই মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকগোষ্ঠী পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানকে উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলো। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করে পাকিস্তানের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে বিস্তর। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতিতে উন্নয়নের কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করা হয়নি। এখানকার আদিম কৃষিনির্ভর অর্থনীতির কোনো রূপান্তর ঘটানো হয়নি একথা যেমন সত্য, তেমন পূর্বাঞ্চলের কৃষিপণ্যের থেকে মুনাফা অর্জন করে পশ্চিমারা তাদের অঞ্চলে সম্পদের পাহাড় গড়েছে তাও সত্য। এখানে কলকারখানা স্থাপন করা হয়নি, শিল্পবাণিজ্য বিকশিত করে তোলার সুচিন্তিত পদক্ষেপ কখনো গ্রহণ করা হয়নি। একটি কৃষিভিত্তিক অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যে একটি পরিকল্পিত উন্নয়ন পরিকাঠামো প্রয়োজন, সে ব্যাপারে একেবারেই নজর দেয়া হয়নি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অল্পস্বল্প যে শিল্প কারখানা গড়ে তোলা হয়েছিলো, সেগুলোর মালিক ছিলেন পশ্চিমারা। পূর্বাঞ্চলের সস্তা কাঁচামাল এবং শ্রমিকের স্বল্প মজুরীর ওপর নির্ভর করে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতিরা নিজেদের সহজ মুনাফা আয় করার তাগিদেই এই অঞ্চলে কিছু কিছু শিল্পকারখানা স্থাপন করেছিলেন। এই সব শিল্পকারখানার লভ্যাংশ এই অঞ্চলে বিনিয়োজিত না হয়ে পশ্চিমে চলে যেতো। পাকিস্তানের বাইশটি প্রধান পুঁজিপতি পরিবারের মধ্যে মাত্র একটিই ছিলো পূর্বাঞ্চলে। পাকিস্তানে যে পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ এবং সাহায্য পশ্চিমের ধনী দেশগুলো থেকে আসতো, তার সিংহভাগ ব্যয় করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। সুফল যেটুকু, ভোগ করতো পশ্চিমারা। পূর্ব পাকিস্তানকে বইতে হতো বৈদেশিক ঋণের দায়ভাগ। তঙ্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিমাদের এই অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে প্রতিবাদ করেছেন, আন্দোলন করেছেন। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তাদের ন্যায্য হিস্যা আদায় করা যখন অসম্ভব বলে মনে হয়েছে, তখনই পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বতন্ত্র একটা অর্থনীতি নির্মাণের কর্মসূচী গ্রহণ করে রাজনৈতিক সংগ্রামে নেমেছেন। মূলতঃ আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচী ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের একটা স্বতন্ত্র অর্থনীতি নির্মাণের দলিল। পশ্চিমারা বরাবরই এই ন্যায্য অধিকারের দাবীকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ষড়যন্ত্র বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে। সত্তরের নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ছয় দফার পক্ষে আওয়ামী লীগকে ভোটের মাধ্যমে নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী করলেও পশ্চিমারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি হয়নি। অধিকন্তু পশ্চিমা সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতিরোধের ব্যুহ চুরমার করে ফেলার জন্য রাতের অন্ধকারে তৎকালীন নিরীহ নিরস্ত্র জনগণের ওপর আক্রমণ চালিয়ে বসেছে। পাকিস্তানী সৈন্যদের হামলার ফলে পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষা করার শেষ সম্ভবনাটির অবসান ঘটলো এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণকে একটি অসম যুদ্ধ ঘাড়ে করে নিতে হলো।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশের সঠিক বিশ্লেষণের জন্য পেছনের ইতিহাসটুকু জানা অবশ্যই প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন হওয়ার পরে যে রাষ্ট্রটি বাংলাদেশে আত্মপ্রকাশ করলো, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে সমাজতন্ত্রকেও সে রাষ্ট্রের একটা মূল স্তম্ভ বলে ঘোষণা করা হলো। বাংলাদেশে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সৃষ্টি করার পূর্বশর্তসমূহ হাজির ছিলো না। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান শক্তি আওয়ামী লীগ তেমন দলও ছিলো না। তথাপি আওয়ামী লীগ সরকার সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় প্রধান নীতিমালার একটি হিসেবে ঘোষণা দিলো এবং একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে হলো।