মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতের কংগ্রেস দলীয় তাত্ত্বিকেরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এই মতাদর্শগত ভিত্তিটির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তাঁদের প্রচার প্রোপাগাণ্ডার ধরনটি থেকে একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে বেরিয়ে এসেছিলো। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সকল ভারতীয় জনগণের এক জাতিত্বের যে দাবী তুলে ধরেছিলো, বাংলাদেশের জন্মের মধ্য দিয়ে সেই জিনিশটিই আবার নতুন করে প্রমাণিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলটির অনুসারী শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের বেশিরভাগই বাংলাদেশের জন্মকে মুহম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রম সংশোধন বলে ব্যাখ্যা করে আসছেন। কিন্তু এই ব্যাখ্যাটির মধ্যে একটা শুভঙ্করের ফাঁক বরাবরই থেকে যাচ্ছে। অবশ্যই প্রশ্ন করা প্রয়োজন, ভারতের হিন্দু মুসলমান দুটি জাতি আলাদা এটা যেমন সত্য নয়, তেমনি সত্য নয় ভারতের সবজাতি মিলে একজাতি। কংগ্রেস তাত্ত্বিক এবং তাঁদের বাংলাদেশী সাগরেদদের ব্যাখ্যা মেনে নিলে বাংলাদেশের একটা রাষ্ট্রিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। ভারতের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়াই বাংলাদেশের রাষ্ট্রিক নিয়তি। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই অবচেতনে হলেও এই ব্যাখ্যাটি সত্য বলে মনে করে থাকেন। তাই তাঁদের মধ্যে এমন একটা ভারতমুখীনতা লক্ষ্য করা যায়, যার অর্থ পরিষ্কার এ রকম দাঁড়াবে-বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটি খণ্ডকালীন অস্তিত্ব মাত্র।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ভারতবর্ষের মানচিত্রে বারবার অদলবলদ ঘটেছে। যদি আরেকবার ঘটে তাতে বাধা কোথায়? একই রকম ভাঙচুর বাংলার মানচিত্রেও ঘটেছে। আরেকবার যে ঘটবে না, সে কথা জোর করে বলার উপায় কি? কিন্তু প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়ে করলে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম জবাব শোনার জন্য তৈরি থাকতে হবে। ভারতের বাঙালী, পাঞ্জাবী, উড়িয়া, বিহারী, কাশ্মীরি, আসামী সকলে মিলে কি একটা জাতি? ভারতীয় যে অধিজাতিত্বের ধারণা বৃটিশ বিদায়ের প্রাক্কালে তৈরি করা হয়েছিলো, সেটা কি এখন ধোপে টেকে? পাঞ্জাব, কাশ্মির, আসাম, নাগাল্যাণ্ড, অরুণাচল এই সকল রাজ্যে একসার অগ্নিগিরির মতো স্বাধীনতা এবং স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে জনগণের সংগ্রাম যেভাবে প্রচণ্ড রোষে ফেটে পড়েছে, সেটা কি সমস্ত ভারতীয় জনগণের এক জাতিত্বের প্রতি আনুগত্যের পরিচায়ক? ভারতের রাষ্ট্র নায়কেরাও আত্মবিশ্বাস সহকারে ভবিষ্যদ্বাণী করতে অক্ষম, ভারত একজাতি হিসেবে চিরকাল অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবে।
ওপরের আলোচনা থেকে একটি সত্য বেরিয়ে আসে। ভারতবর্ষ শুধুমাত্র হিন্দু মুসলমান দু’জাতির দেশ যেমন নয়, তেমনি একজাতির দেশও নয়। বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু বর্ণ, বহু ধর্ম, অঞ্চল এবং নানা জনগোষ্ঠীর আবাসভূমি হিসেবে ইতিহাসের শুরু থেকেই তার অস্তিত্ব রক্ষা করে আসছে। বৃটিশ বিদায়ের প্রাক্কালে দুর্বলতরো জাতি, সম্প্রদায় এবং জনগোষ্ঠীগুলো তাদের দাবী উধ্বে তুলে ধরতে পারেনি বলেই একটি জগদ্দল রাষ্ট্রের বোঝা তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে সবাইকে ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে না, কাঠামোতেই টান লাগছে।
উনিশশো বাহান্ন থেকে শুরু করে একাত্তর পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের যতোগুলো আন্দোলন হয়েছে, যতো ধরনের গণসংগ্রাম রচনা করেছে তার একটা ইতিবাচক প্রভাব ভারতের নির্যাতিত অঞ্চল এবং জনগোষ্ঠীর ওপর অনিবার্যভাবে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের উনিশশো বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের পরে আসাম, অন্ধ্র ইত্যাদি অঞ্চলে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম ভারতের পাঞ্জাব এবং কাশ্মিরের মতো বিচ্ছিন্নতাকামী রাজ্যসমূহের জনগণের ভারত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এসে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র। প্রতিষ্ঠার সগ্রামে প্রেরণার উৎস হিসেবে ক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করেছে।
একটা বিষয় শুরু থেকেই পরিষ্কার করে নেয়া প্রয়োজন। নানা অপূর্ণতা ও সীমাদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুসারে ভারত উপমহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশ সব চাইতে আধুনিক রাষ্ট্র। ভাষাভিত্তিক জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশের উত্থান আধুনিক ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে সব চাইতে অভিনব ঘটনা। বাংলাদেশ জাতি রাষ্ট্রের আদর্শ উর্ধ্বে তুলে ধরে তাবত ভারত উপমহাদেশের অবহেলিত অঞ্চল এবং জনগোষ্ঠীর ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে এবং দিনে দিনে সে প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উত্থান স্বীকার না করে যারা শুধুমাত্র জিন্নাহ সাহেবের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রম সংশোধনকেই বাংলাদেশের জন্মের কারণ মনে করেন; জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে এমন একটা ভ্রান্তির মধ্যে নিজেদের নিক্ষেপ করেন, চূড়ান্ত বিচারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই একটা খণ্ডকালীন ব্যাপার বলে মেনে নিতে তারা কদাচিত দৃষ্টভঙ্গীগত বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হতে পারেন। বাংলাদেশ ভাষাভিত্তিক জাতি রাষ্ট্রের গন্ত ব্যটি দ্বৰ্থহীনভাবে আমাদের জনগোষ্ঠীর মনে অনপনেয়ভাবে গেঁথে দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে।