উনিশশো একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশে যে নতুন একটি রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে তার ভেতরের যে সংকট তার সঙ্গে সাম্প্রতিক কালে দুটি প্রধান দলের মধ্যে যে প্রতীকী বিরোধ চলছে তার সম্পর্ক নিতান্তই ক্ষীণ। আসলে যাহা জল তাহাই পানি। বাংলার হিন্দুরা পানিকে জল বলে। আর বাংলার মুসলমানেরা জলকে পানি বলে। আবার বাংলার বাইরে হিন্দু মুসলমান সবাই জলকে পানিই বলে থাকে। পানি শব্দটি সংস্কৃত থেকে এসেছে। জল বাংলা শব্দ। জল পানির মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। তারপরেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাংলার হিন্দু মুসলমানের বিরোধ জল অথবা পানি শব্দ দুটো উচ্চারণের মধ্য দিয়েই প্রতীকী ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। সংকটের আসল এলাকাকে পাশ কাটিয়ে প্রতাঁকের মধ্যে বিরোধ আবিষ্কার করার প্রবণতার কারণ বীজ বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্য প্রক্রিয়ার মধ্যেই অনুসন্ধান করতে হবে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দান করার কৃতিত্ব দাবী করে থাকে। দলটির এ দাবী একটুকুও অসঙ্গত নয়। তা সত্ত্বেও এ কথাটি অসত্য নয় যে সমস্ত নেতা আওয়ামী লীগের জন্ম প্রক্রিয়াটি সূচীত করেছিলেন, তাঁরা সকলেই পাকিস্ত নি আন্দোলনের নেতৃত্বদান করেছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রধান স্থপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবুর রহমান এই তিন ব্যক্তিত্ব পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় প্রণিধানযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের কাছ থেকে ন্যায্য অংশ আদায় করার দাবীতে তারাই আবার আওয়ামী লীগ সংগঠনটি দাঁড় করিয়েছেন। আপোষ আলোচনার মাধ্যমে ন্যায্য দাবী আদায় করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো বলে, আওয়ামী লীগকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠমো থেকে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করার দায়িত্ব স্বীকার করে নিতে হয়েছে।
নির্মোহভাবে দৃষ্টিপাত করলে একটা বিষয় সকলের চোখে স্পষ্টভাবে ধরা পড়বে। আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রাজনীতির মধ্যে যে সকল চিন্তা চেতনা ক্রিয়াশীল সেগুলোকে অতীতের পাকিস্তানী রাজনীতির জের কিংবা সম্প্রসারণ বলে অভিহিত করলে খুব বেশি অন্যায় হবে না। মুসলিম লীগের বীজতলা থেকেই আওয়ামী লীগের জন্ম এবং দলটি মুসলিম লীগের রাজনীতির বেসামরিক ঐতিহ্যের ধারক বাহক। যতদিন পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি মধ্য শ্রেণীর বিকাশ হয়নি, আওয়ামী লীগের সমর্থন এবং আনুগত্য কম্পাসের কাঁটার মতো পশ্চিমের দিকে হেলে থাকতো। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর উত্তরাধিকার ধারণ করছে একথা বললেও খুব একটা মিথ্যা বলা হয় না। যদিও এরই মধ্যে দলটিতে অনেক নতুন উপাদান সংযোজিত হয়েছে, তথাপি জন্ম প্রক্রিয়ার সেই প্রাথমিক বোধগুলো এখনো সক্রিয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল যে উৎস থেকে জন্ম লাভ করেছে, সেই একই উৎস থেকে জাতীয় পার্টিরও উদ্ভব। তারতম্যের পরিমাণ নির্ভর করছে অন্যান্য সামাজিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ওপর। বাংলাদেশটির দুর্ভাগ্য হলো এই যে, দেশটির প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে বিপুল পরিমাণ অতীতের দায়ভার বহন করতে হচ্ছে। অতীতের ভূত কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে বর্তমানের নিরিখে কর্মকাণ্ড নির্ধারণ করার কোনো লক্ষণ পরিদৃশ্যমান হচ্ছে না। অতীতের ধারাবাহিকতার সূত্র ধরেই তারা দেশটা শাসন করতে চান। তাই প্রধান দুটো রাজনৈতিক দলের আচরণের মধ্যে ভারত এবং পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য এতোটা প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে, তার মধ্যে বাংলাদেশ কততটা উপস্থিত সেই জিনিশটিই দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশের যে একটি আত্মা আছে, তা আবিষ্কার করতে সক্ষম নয়। সে কারণে সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসগত বিভেদ পাশ কাটিয়ে শব্দ বা শব্দবন্ধ নিয়ে কলহ করে সময় যাপন করে থাকেন।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি জন্মাবার পেছনে ধারণাগত একটা ভ্রান্তি অদ্যাবধি প্রবলভাবে বিরাজমান। বলা হয়ে থাকে ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতর থেকে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার দাবীতে এই রাষ্ট্রটির উত্থান হয়েছে। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জন্য সুনিশ্চিত করেছিলেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি মুসলমান হিন্দু দুটি আলাদা জাতি, এই প্রত্যয়টি খারিজ করে দিয়ে জন্ম লাভ করেছে। শুধু এটুকু যদি বলা হয় সম্পূর্ণ সত্য বলা হয় না। একটু ইতিহাসের পেছনে যাওয়া প্রয়োজন। এক সময়ে ভারতবর্ষের হিন্দু এবং মুসলমান একটি রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে বসবাস করতে সম্মত হয়নি বলেই ভারত এবং পাকিস্তান দুটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম সম্ভাবিত হয়েছে। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ দাবী করেছিলেন, ভারতের মুসলমানেরা নিজেরাই আলাদা একটি জাতি। সুতরাং একটি স্বতন্ত্র বাসভূমি পাকিস্তান প্রয়োজন। অন্যদিকে মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু এবং মাওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ নেতা দাবী করেছিলেন, ভারতের সব সম্প্রদায়ের জনগণ মিলেই একটি জাতি। সুতরাং ভারতকে হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভাগ করা কখনো উচিত হবে না। তারপরেও দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতকে বিভক্ত করা হয়েছিলো এবং মুসলমানদের একটি স্বতন্ত্র বাসভূমির দাবী পাকিস্তানকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। সিকি শতাব্দীর মধ্যেই পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি জন্ম নিলো । জিন্নাহ সাহেবের দ্বিজাতিতত্ত্ব সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা হয়ে গেলো। কথাটি এতোই দিবালোকের মতো সত্য যে, এ নিয়ে আর কোনো তর্ক চলতে পারে না।