রেনেসাঁর মূলকথা মানুষের জীবন সম্পর্কিত সমস্ত বিষয়ের নতুন মূল্যায়ন এবং বাস্ত বতা সম্মত উপায়ে কি ব্যক্তিক জীবনে, কি সামাজিক জীবনে স্বীকার করে নেয়া। এই কাজটিতেই প্রয়োজন জ্ঞানের। যখনই আমাদের সমাজে স্বীকৃতি পাবে-জ্ঞানই শক্তি, তখনই আমাদের দেশে সম্ভাবিত হয়ে উঠবে একটি রেনেসাঁ। সমাজের মুখ্য অংশে জ্ঞানের শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পূর্ব শর্ত একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক পদ্ধতি ব্যক্তির অন্ত জীবনের মহিমা এবং তার ব্যক্তিত্বের অনন্যতা স্বীকার করবে। একই সঙ্গে সামাজিক জীবনের দাবির প্রতি সচেতন থাকবে। এই ধরনের একটি রাজনৈতিক পদ্ধতি সৃষ্টি করার কাজ সহজসাধ্য নয়-বিশেষতঃ আমাদের এই দেশে। তার কারণ, আমাদের মানুষ অশিক্ষিত এবং কুশিক্ষিত, কুসংস্কারে তাদের চিন্তা-চেতনা আবদ্ধ। দেবতা পুজোর মতো ব্যক্তি পুজোয় তারা অভ্যস্ত, সাম্প্রদায়িকভাবে ছাড়া অনেক চিন্তাও করতে পারেন না। সুতরাং এই দেশে মামুলী অর্থে যাকে আমরা রাজনীতি বলি, তাই দিয়ে মানুষের চরিত্রের আমূল সংস্কার সাধন করে একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক পদ্ধতি নির্মাণ করার কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব নয়। ইজমের’ পর ইজম’ আসতে পারে। থিয়োরী আর থিয়োরীর জঙ্গলে মানুষের চিন্তা ভাবনা দিকচিহ্নহীন হয়ে পড়তে পারে। কিন্তু মানুষের স্বভাব এবং চিন্তাধারা পরিবর্তন হবে না। মানুষের চিত্তবৃত্তির উন্নতি সাধন না করে, তার বুদ্ধিবৃত্তিতে পরিশীলন না এনে, জ্ঞানের আগুন বুকে না জ্বালিয়ে তাকে একটা সমাজ ভেঙ্গে আরেকটা সমাজ নির্মাণের কাজে ঠেলে দেয়াও একধরণের জবরদস্তি । শেষ পর্যন্ত জবরদস্তি পশুর সমাজে চললেও মানুষের সমাজে চলে না। আজকে যে সকল রাজনৈতিক দল বোধবুদ্ধিহীন উপায়ে মানুষকে বিপ্লবের মায়া কাননের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে, তারা হয়তো মিথ্যা বলছে অথবা সমাজে জবরদস্তির রাজত্ব কায়েম করতে চাইছে। দুটোই যে ব্যর্থ হবে, ব্যর্থ হতে বাধ্য, সে কথা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।
সামাজিক বিপ্লবের পূর্ব শর্ত সমাজের মুখ্য অংশে জ্ঞানের শাসন প্রতিষ্ঠিত করা। মানুষ তার পূর্বপুরুষ মানুষের কাছে যা কিছু পেয়েছে, তার মধ্যে জ্ঞানই সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদএই জ্ঞান প্রয়োগ করে তার যৌহ জীবন কিভাবে সে চালাবে এরকম চিন্তা এবং কর্মে সে যদি উদ্দীপিত হয়ে না উঠে তাহলে কেন সে বিপ্লব করতে যাবে? মানুষ কি কখনো স্বেচ্ছায় সন্ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টির কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারে? কিন্তু মানুষের প্রচেষ্টা এবং চিত্ত সড়েও অনেক সময় নিজেদের শক্তি ও দুর্বলতা কোথায় জানতে পারে না। লোকচরিত্রের রহস্য বুঝতে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে থাকে। তাই তারা ভাবে এক, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে হয়ে যায় ভিন্ন, করতে চায় একরকম, কিন্তু হয়ে যায় অন্য রকম। তাই প্রতিটি সামাজিক বিপ্লবকে সুষ্ঠুভাবে প্রবাহিত করার জন্য মানুষের মননশীলতার পরিবর্তন সাধন সম্ভব নয়, তাই প্রতিটি রাজনৈতিক বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে একটা মানসবিপ্লবেরও প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে পড়ে। বাঙলাদেশে বর্তমানে যে মানন বিপ্লবের প্রয়োজন অমোঘ হয়ে উঠেছে, তার রূপটি কি হবে সে বিষয়ে একটা প্রাথমিক ধারণা নেয়া অবাস্তব হবে না আশা করি; পাকিস্তানী আমলে পাকিস্তানী শাসকেরা ইসলাম, মুসলমান কোরআন এবং হাদিসের নামে এমন কতিপয় ধারণা চালু করেছিলো, যেগুলোর পেছনে কোনো বাস্তব সত্যের স্বীকৃতি নেই! পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাতারাতি যে ধারণাগুলোও চলে যায়নি। রঞ্চ অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মানুষের মনের মধ্যে তার শিকড়ও অনেকদূর বিস্তৃত। সে ধারণাগুলোর অযৌক্তিকতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখাতে হবে। সেগুলো যে জীবন বিরোধী, সভ্যতা বিরোধী-আমাদের জনগণের সামনে তা প্রমাণ করতে হবে। পাকিস্তানীদের দ্বারা প্রবর্তিত সমস্ত ধারণা অবৈজ্ঞানিক, সমস্ত আইন-কানুন পদ্ধতি তৎকালীন পূর্ব বাংলাকে উপনিবেশ রাখার জন্যই প্রয়োগ করেছে এবং যা মানুষের মনে গভীর ছাপ রেখেছে, তার অশুভ প্রভাব থেকে মানুষের মন এবং চেতনাকে সৃষ্টিশীল উপায়ে মুক্ত করতে হবে। আবার যারা সনাতন বাংগালীয়ানার বড়াই করেন, কোম জীবনের গুণগান করেন, অনগ্রসর সামন্তভিত্তিক কৃষি সভ্যতার ঢিলে-ঢালা মন্থর জীবনের মূল্য চিন্তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তারাও বাঙ্গালী সমাজ ও সংস্কৃতির গতিকে পশ্চাদমূখী করতে চান। তার অর্থ হলো, বাংগালীর ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করা, বাঙলাদেশও যে ভূগোলের একটা চিহ্নিত অংশ সে সত্যের অপলাপ করা, বাঙলার জনগণ যে পৃথিবীর জনগণের একটা ভগ্নাংশ, এই দিবালোকের মতো সত্যকে অস্বীকার করা। বস্তুতঃ আমাদের মন-মানসে বর্তমানে দুই ধরণের অন্ধতা বর্তমান। এই পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক আরোপিত অন্ধতা, অন্যটা স্বেচ্ছা অন্ধতা। আমাদের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী এরকম বুঝিয়ে থাকেন যে বাঙলা ভাষা এবং সংস্কৃতির উৎকর্ষ যা হওয়ার বৃটিশ আমলে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের সাধনায় হয়ে গেছে, বাঙলা সাহিত্যের যতোটুকু শ্রীবৃদ্ধি পশ্চিম বাঙলায় হয়েছে, তার বাইরে একচুল অগ্রসর হওয়ার সামর্থ্যও নেই। তারা ঠিক একথা স্পষ্টভাবে বলেন না, কিন্তু যে মানসিকতা দিয়ে তাঁরা রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল, বিদ্যাসাগর এবং সংস্কৃতির অত্যন্ত বরেণ্য পুরুষদের বিচার করেন, তা অনেকটা এই রকম। এই অর্থহীন অতীতচারিতা ভবিষ্যৎ থেকে আমাদের দৃষ্টি অতীতের দিকে নিয়ে যায় এবং শাসকশ্রেণী গদী রক্ষার কারণে এই অতীতচারিতাকেই অধিক মূল্য দিয়ে থাকে। তার দুটি কারণ। একদিকে আত্মপ্রসাদ অনুভব করতে পারে–জাতীয় সংস্কৃতির চর্চা করছি, অন্যদিকে শাসন ত্রাসনও অব্যাহত রাখা যায়।