অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের কোনো কোনো বুদ্ধিজীবীকে বলা হয় আমেরিকার মানুষ, কাউকে রাশিয়ার, কেউ চীনের কেউ ভারতের এবং কেউবা পাকিস্ত নের। এদের অনেকের সম্বন্ধে পরিস্কার ভাষায় বলে দেয়া যায় দালাল। শুধু অর্থের জন্যই বিদেশী শক্তির দালালি করে। কিন্তু সকলে এই হীন অর্থে দালাল নন। যদি বা দালালি করেন, সে সম্বন্ধে নিজেরাও বিশেষ সচেতন নন। কারণ তাঁরা মানুষের মুক্তির আদর্শে বিশ্বাসী। স্কুল লোভের কারণে বিদেশী শক্তির হয়ে কাজ করেন, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
তাঁদের অনেকে অন্ধভাবে চীন, রাশিয়া প্রভৃতির দেশের সব কিছুকে এ কারণে সমর্থন করেন যে, ওসব দেশে সমাজ এমন করে ঢালাই করে ফেলেছে জনগন, সেখানে মানুষে মানুষে সমতার আদর্শ অনেকাংশে বাস্তবায়িত হয়েছে। এই মুগ্ধতাই তাঁদের অন্ধতার কারণ। সেখানে মানুষে মানুষে সমতার আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একথা সত্য, কিন্তু তাতেও ভেবে দেখলে আমাদের পুলকিত হওয়ার খুব বেশী প্রয়োজন নেই। কারণ আমাদের কাছে সব চেয়ে যেটা প্রত্যক্ষ, যেটা খাঁটি সে হলো, আমাদের দেশ এবং দেশের মানুষ। এই দেশ বহির্ভূত মানসিক আনুগত্যের চাইতে ক্ষতিকর আর কিছু নেই। একটি দৃষ্টান্ত দিলে, বিষয়টি পরিষ্কার হবে। খিলাফত আন্দেলনের সময়ে ভারতবর্ষের মুসলমানেরা এককাট্টা হয়ে বৃটিশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলো তুর্কীর খলিফার রাজত্ব রক্ষা করার দাবিতে। সেই দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে, গোটা খেলাফতের ব্যাপারটাই ছিলো অবৈজ্ঞানিক, দেশ বহির্ভূত এবং না ধর্মী আন্দেলন। কার্য কালে দেখা গেলো খালিফাঁকে খেদিয়ে দেশের বের করে দিয়ে মুস্তাফা কামাল পাশা এক নবযুগের সূচনা করলেন। সে সময়ে মুগ্ধদৃষ্টিতে মুসলমানেরা যেমন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের রাজধানীর দিকে তাকিয়ে থাকতেন, তেমনি ভাবে প্রগতিশীল বলে কথিত বুদ্ধিজীবীরা সমাজতান্ত্রিক দেশসমুহের রাজধানীগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন। যদিও এই দুই মোহমুগ্ধতার মধ্যে কিছুটা গুণগত পার্থক্য রযেছে।
অনেকে ভেবে দেখতে রাজি নন যে, সমাজতান্ত্রিক দেশসমুহের সমাজতন্ত্রের প্রচারের চাইতে আরো বেশী কিছু সমস্যা রয়েছে। তাদের খেয়ে পরে বাঁচতে হয়, গৃহ এবং বহিঃ শত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে হয়, অপরের সঙ্গে কারবার তেজারতী করতে হয় এবং তদুপরি তাদের পররাষ্ট্র নীতি বলে একটা যে জিনিশ আছে সে বিষয়ে আদৌ ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করেন না। আজকের সেভিয়েত রাশিয়া এবং চীনের পররাষ্ট্র নীতির কথাই ধরা যাক। দুটি দেশের বর্তমান পররাষ্ট্র নীতির মধ্যে এমন অনেক কিছু রয়েছে যার সঙ্গে জারদের এবং চীনা সম্রাটদের অনুসৃত নীতির সঙ্গে মিল বর্তমান। তাদের আমরা যতোদূর সমাজতন্ত্রের প্রসার প্রচারের বন্ধু মনে করি, আসলে তাঁরা ততোটা নয়। গভীরভাবে বিচার করলে দেখা যাবে ও সমস্ত দেশ জাতীয় স্বার্থকেই সব সময়ে প্রধান্য দিয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের কতিপয় বুদ্ধিজীবী এ বিষয়টি বুঝতে চান না,বড় লোকেরা গরীব অহঙ্কারী আত্মীয়ের মতো, তাঁরা সমাজতান্ত্রিক দেশের সমর্থক সে গর্বে দেশের মাটিতে পা ফেলেন না। এঁদের জন্য দুঃখ করা যায়, করুণা করা যায় । কিন্তু ওই বিদেশাভিমুখিতা যদি ব্যাপক হয় তাহলে আমাদের দেশের সমাজ পরিবর্তনের কাজটি বিলম্বিত হবে। তাই সমাজতান্ত্রিক দেশের যে সংস্কৃতি তা সে সকল দেশের সমাজ বাস্তবতার ফসল। তারা সমাজ ভেঙ্গে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠা করে নতুন সংস্কৃতির সৃষ্টি করেছে। প্রতিটি সমাজের মানুষকেই তার নিজের সমাজ পরিবর্তন করে গড়তে হয় নিজেদের সংস্কৃতি। যা কিছু আমরা রক্ত দিয়ে, প্রাণ দিয়ে, চিন্তা দিয়ে, স্বপ্ন দিয়ে সৃষ্টি করিনি, তাতে আমাদের অধিকার নেই। এই সংস্কৃতিতে অধিকারবোধটি গভীর নয় বলেই আমাদের দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী নিজের দেশের ইতিহাসের বদলে চীন-রাশিয়ার ইতিহাস মুখস্ত করে। আসলে এটাও একটা পলায়নী মনোবৃত্তি, এই পলায়নী মনোবৃত্তি থেকেই রাজনীতি সংস্কৃতিতে লেজুরবৃত্তির জন্ম। আগে আমরা লেজ না মাথা সেটিই ঠিক করতে হবে। মহামতি লেনিন শ্রমিক শ্রেণীর বন্ধু কথাটি সত্য। কিন্তু জার্মানীর মানুষের তো তা দিয়ে কোনো লাভ হয়নি। জার্মানীতে হিটলার এসে বসেছিলো, জার্মানীর শ্রমিকরা কিছুই করতে পারেনি। কারণ জার্মানীর শ্রমিক শ্রেণী, জার্মানীর রাজনৈতিক আন্দোলন, জার্মান লেনিন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। তেমনি আমাদেরও চীনা লুসুন কিংবা রাশিয়ান গর্কী দিয়ে চলবেনা। আমাদের চাই নিজেদের মানুষ, আমাদের গণ সংগ্রামের উত্তাপ থেকে জন্ম হবে যাদের ।
.
আমাদের দেশে একটি রেনেসাঁর লক্ষণ জীবনের নানা ক্ষেত্রে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে! কি সংস্কৃতি চিন্তায়, কি রাজনীতিতে এমন কতিপয় লক্ষণ এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ফুটে বেরিয়েছে, পূর্বের যুগে তা ছিলো সুপ্ত, চিন্তাবিদদের চিন্তা এবং স্বাপ্নিকদের স্বপ্নের বিষয়। যেহেতু পুরনো সমাজের গর্ভ থেকে একটা নতুন সমাজ জন্ম নেয়ার বেদনা এখন তীক্ষ্ণভাবে অনুভূত হচ্ছে, তাই নতুন এবং পুরনোর মধ্যে সংঘাতটাও তীব্র আকার ধারণ করেছে। এই সংঘাত শুধুমাত্র পাকিস্তানী সংস্কৃতি এবং পাকিস্তানী আমলের সমাজের সঙ্গে প্রাদেশিক বাঙ্গালী সংস্কৃতি এবং কৃষিভিত্তিক অনগ্রসর বাঙ্গালী সমাজের মধ্যে সীমিত নয়। আবহমান কালের ঐতিহ্যভিত্তিক স্থবির প্রায় বাঙ্গালী সমাজ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে আন্তর্জাতিকতা অভিমুখী বাঙ্গালী সমাজ সংস্কৃতির সংঘাতটাও বড়ো বেশী মুখিয়ে উঠেছে। শেষোক্ত সংঘাতটাকে বাঙ্গালী জনগণের মুক্তি সংগ্রামই সুনির্দিষ্ট আকার দান করেছে এবং সঞ্চারিত করেছে তাতে বেগ আর আবেগ। নিজেদের কিছুকে অস্বীকার না করে বিশ্বের যা কিছু মহীয়ান, গরীয়ান তা গ্রহণ করা এবং একই সঙ্গে নিজেদের যা কিছু অস্বাস্থ্যকর এবং জীবন বিরোধী মনে হবে, বর্জন করার মধ্যেই আমাদের জাতীয় রেনেসাঁর ভবিষ্যৎ সংগুপ্ত রয়েছে।