কিন্তু কোলকাতার সঙ্গে ভাবের আদান প্রদান, মতের বিনিময় পুরোপুরি চালু রাখা প্রয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে কোলকাতার যে সমস্ত কাগজ যেমন ‘দেশ’, ‘আনন্দ বাজার’, ‘অমৃতবাজার’, ‘যুগান্তর’, ‘জলসা’ ইত্যাদি আমাদের দেশে ব্যাপক হারে চলছে, সেগুলোর দিকে সন্দেহের চোখে না তাকিয়ে উপায় নেই। কেননা সে সকল কাগজের একমাত্র লক্ষ্য কাটতি । টাকা উপার্জন ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু আমাদের দেশে একটি নতুন সমাজ আদর্শ, একটি নতুন সংস্কৃতি সৃজনের প্রয়োজন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। শুধু লোকরঞ্জনের অভিপ্রায়ে যে সকল কাগজ, সেগুলো বেশী পড়লে আমাদের জনগণের চেতনা থিতিয়ে যাবে। একইভাবে বিদেশী যে সকল যৌন পত্র পত্রিকা, হালকা গোয়েন্দা বই আমাদের দেশে আসে সেগুলোর প্রসারও রোধ করতে হবে। ভাবতে অবাক লাগে বিজ্ঞানের জার্নাল, দর্শনের বই আমাদের বই বিক্রেতারা আনে না, আনে নোংরা বই।
সরকারের ওপর নির্ভর করে বিশেষ লাভ হবে মনে হচ্ছেনা। কারণ সরকার ইতিমধ্যে যে সকল নীতি নির্ধারণ করেছেন, তাতে নতুন চিন্তার প্রসারের স্থান নেই বললেই চলে। সরকার এমনভাবে প্রেস-ট্রাস্টের কাগজগুলো, রেডিও-টেলিভিশন এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহ নিয়ন্ত্রণ করছেন তাতে স্বাধীন চিন্তা যা সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান শিল্প-সাহিত্যের প্রাণবস্তু তার কোনো স্থান নেই। সুতরাং সে সকল পত্র পত্রিকা থেকে জাতির জন্য মঙ্গলকর কিছু বেরিয়ে আসতে আশা করা অবান্তর। তেমনি সরকারী উদ্যোগে যে সকল সাহিত্য সভার অনুষ্ঠান হচ্ছে, তাতে নতুন সংস্কৃতি সৃজনের উত্তাপ বিকীরণের বদলে তোষামোদ এবং আমলাতান্ত্রিকতাই প্রধান্য পাচ্ছে। কিন্তু সরকার তো আর দেশ নয়। এ সরকার খারাপ করলে টিকতে পারবেন না। জনগণ নতুন সরকার আনবেন। সুতরাং জনগণেরই দায়িত্ব সাময়িক পত্র প্রকাশ এবং ঘন ঘন সাংস্কৃতিক সম্মেলন, ঘরোয়া বৈঠক ইত্যাদির অনুষ্ঠান করে সাহিত্যের উন্নতি সাধন করা এবং সংস্কৃতির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করা।
.
আমরা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবার চেষ্টা করছি। আমাদের সবদিকে উদ্ভাবনী শক্তির উদ্বোধনের বদলে আমরা অপরের অনুকরণ করে আত্মপ্রবঞ্চনা করছি। ভালো জিনিশ অনুকরণ করার মধ্যে দোষের কিছু নেই, কিন্তু অন্ধ অনুকরণটা কি কখনো ভালো? যে সমাজে আমাদের পিতৃপুরুষেরা জীবন অতিবাহিত করেছেন, যে সমাজে পাকিস্তানী একনায়কোরা চুটিয়ে রাজত্ব করেছে তার কাঠামোটা তো ভেঙ্গে গেছে। যে মূল চিন্তার উপর আমাদের সমাজকে জোর করে স্থিত রাখা হয়েছিলো তা ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। এখন আমাদের নতুন মূল চিন্তা সৃষ্টি করার এবং সে অনুসারে গোটা সমাজকে ঢালাই করার সময়। এখন কথা দাঁড়ালো যে নতুন সমাজ সৃজনের তাগিদ সমাজের গভীর থেকে সঞ্চারিত হয়েছে, গণমানুষের জীবনের দাবী যাকে প্রায় অবশ্যকরণীয়ের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে এবং যা বাঙলাদেশের ঐতিহাসিক অহং বা হিষ্ট্রিক ইগোর’ অভ্যুদয়ের শামিল তার দিকে মনোযোগ দেবো না কি বিদেশের দিকে তাকিয়ে তাদের সাফল্যে আত্মহারা হয়ে আনন্দে বগল বাজাবো, সেটা স্থির করা আমাদের মৌলিক এবং প্রাথমিক কর্তব্য। রাশিয়া আমেরিকার মানুষ চাদে গেছে, রাশিয়ার শ্রমিকরা জারতন্ত্রের উচ্ছেদ সাধন করে মেহনতী মানুষের নেতৃত্বে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী সমাজ নির্মাণ করেছে। তেমনি করেছে অপরাপর সমাজতন্ত্রী দেশের মানুষ। এসব সংবাদে আমাদের জন্য শুভ সংবাদ বয়ে এনেছে। মানুষ আত্মবিশ্বাসে উদ্ভাবনী শক্তির ব্যবহার করতে পারলে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে, গ্রহান্তরেও যাত্রা করতে পারে। যারা চাদে গেছে তারাও মানুষ-আমাদেরই স্বজাতি। তাদের বিজয়ে আনন্দিত হওয়ার অর্থ হলো, যেহেতু আমরাও মানুষ, চেষ্টা করলে হয়তো আমরাও কোনো দিন দুরুহ সাধনায় সিদ্ধি লাভ করতে পারবো। তেমনি শ্রমিক শ্রেণীর বিজয়ে আমরা আনন্দিত হই এই কারণে, আমাদের মতো যে সব দেশে দৈব দুর্দৈব রাজত্ব করতো, মুষ্টিমেয় মানুষ সমাজের অধিকাংশ মানুষকে শাসন এবং শোষণ করতো, জনগন তাদের দুঃখ দুর্দশাকে বিধিলিপি মনে করে অপমান আর লাঞ্চনা সহ্য করতো, তারা এক যোগে দাঁড়িয়ে শোষক শ্রেণীর হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে নিজেরাই মালিক হয়েছে সব কিছুর এবং সে সঙ্গে শোষক শ্রেণীর পোষিত বিশ্বাস সংস্কার সব ঝেটিয়ে তাড়িয়ে মানুষের বাস্তব জীবনের সাথে সম্পর্কিত বিশ্বাস এবং ধারনাকে সমাজের মর্মকেন্দ্রে স্থান দিয়েছে। এই দৃষ্টান্তে আমাদের আনন্দিত এবং উৎসাহিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ আমাদের দেশের মানুষ যদি চায় তারাও অনুরূপ আরেকটি বিল্পব আমাদের দেশে সম্পন্ন করতে পারে। যেহেতু সামাজিক বিপ্লব সমাজ বিজ্ঞানের এবং রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি বিষয়, নিপীড়িত শ্রেণী যদি বিপ্লব সাধন করতে চায়, তাহলে অবশ্যই ধারাবাহিকভাবে বিপ্লবের শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। আমাদের দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের কর্তব্য হওয়া উচিৎ আমাদের জনগনের মধ্যে ইতিহাসের এই গতিধারাটির বোধ চাড়িয়ে দেয়া এবং যে সকল সংস্কার বিশ্বাস ইতিহাসের স্বাভাবিক গতি পথে বাধা রচনা করে, সে সকল প্রতিবন্ধক অতিক্রম করবে কি করে, তার বিষয়ে ওকেফহাল করা। মানুষের বোধকে উন্নত করা, রুচিকে পরিশীলিত করা, সংগ্রামী মানবতার প্রতি মানুষকে শ্রদ্ধাশীল এবং কায়িক মানসিক শ্রমের প্রতি যত্নশীল করে তোলাই এ পর্যয়ে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কাজ।