পাকিস্তান আমলে ঔপনিবেশিক সরকার চাইতো না বাঙলাদেশের পত্র-পত্রিকার প্রসার হোক, বাঙালী সৃজনশীল কর্মে আত্মনিয়োগ করুক। তা করলে ভয় ছিলো, বাঙালী শিল্প-বিজ্ঞানে, সাহিত্য-ইতিহাসে তার জাতির মানস যাত্রার ভঙ্গীটির সঙ্গে পরিচিত হলে একদিন স্বাধীনতা ঘোষণা করবে। এই আশঙ্কাবশত তারা বাঙালীর সাংস্কৃতিক বিকাশ নানান দিকে ঠেকিয়ে রেখেছিলো। সেই কারণে পাকিস্তানী আমলে উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিধর্মী কোনো সাময়িক পত্রের জন্ম হয়নি। সমকাল জাতীয় যে দু’য়েকটা সাময়িক পত্রের দান এদেশের সংস্কৃতির বিকাশে স্মরণীয় তাও কোনো দিন পাকিস্তানী সরকারের আরোপিত বিধিনিষেধের পরিপন্থী কোনো চিন্তা ভাবনা করতে পারেনি।
উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় কি তৃতীয় পাদ পর্যন্ত বাঙলার সব রকমের অগ্রগতির বিষয় স্নিগ্ধ মস্তিষ্কে বিচার বিবেচনা করলে দেখতে পাবো বহতা নদীর মতো একটা না একটা সাময়িকপত্র জনমতকে শিক্ষিত করছে, নতুন চিন্তাধারার বিকাশ সাধন করছে, নতুন প্রতিভা সৃজন করছে। বাঙলার সংস্কৃতির, রাজনীতির, সাহিত্য-বিজ্ঞানের যারা বরেণ্য পুরুষ বলে আমরা মনে করি, এই সকল সাময়িক পত্র না থাকলে তাদের কারো জন্ম হতো না, সে কথা বলাই বাহুল্য। উনবিংশ শতাব্দীর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ‘সংবাদ প্রভাক’, ‘বঙ্গ দর্শন’, ‘প্রবাসী’ থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের ‘কল্লোল’, ‘পরিচয়’, প্রভৃতি পত্র-পত্রিকা বাদ দিলে দেখতে পাবো, যাদের দানে বাঙালী সমাজ উর্বরা হয়েছে, সমৃদ্ধ হয়েছে বাঙলা সাহিত্য, রাজনীতিতে এসেছে বেগ, এই সাময়িক পত্র পত্রিকাগুলোর পেছনে না তাকালে তাদের জন্ম সম্ভব হতো না।
সাময়িক পত্রপত্রিকা বহতা নদীর মতো আর সামাজিক ভাবে শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শনের আলোচনা আলো-বাতাসের মতোই প্রয়োজনীয়। পৃথিবীর সব দেশেই দেখা গেছে নতুন যুগের সূচনা হওয়ার সময়ে, নতুন চিন্তাধারা বিকাশ লাভ করার সময়ে, নতুন সমাজ নির্মাণ করার প্রাক্কালে সমমনা মানুষেরা পরস্পর মিলিত হয়ে, একে অপরের গুণাবলীর তারিফ করেছেন, দোষ দেখিয়ে দিচ্ছেন, পারস্পরিক সহযোগীতার ক্ষেত্র প্রশস্ত করছেন, একই লক্ষ্যে কাজ করার ভিত্তিভূমি প্রতিষ্ঠা করছেন। অন্যান্য দেশের কথা বাদ দিয়ে বাঙ্গালী সমাজের উনবিংশ শতাব্দীর কথাই ধরা যাক। রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত ‘আত্মীয় সভা থেকে ব্রাহ্ম ধর্মের সূত্রপাত। এই ব্রাহ্ম ধর্মের সংবৃদ্ধির কারণ ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারে প্রতিষ্ঠিত ‘হিন্দু মেলায়’ই উত্তরকালে নানাবিধ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়ে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের রূপ এবং আকার পেয়েছে। এমনকি বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময়েও বাঙলাদেশের জেলায় জেলায় নানা সাংস্কৃতিক সম্মেলন হতো। সে সব সম্মেলনে নানা জাতীয় সমস্যার বিষয় অত্যন্ত আন্তরিকতা সহকারে হিতৈষণার বাণী গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়তো। সারা দেশে জ্ঞান বিদ্যা চর্চার একটা হাওয়া আপনা থেকেই সৃষ্টি হতো।
কিন্তু আমাদের বাঙলাদেশে সে রকম কোনো কিছুই করা হয়নি। মাঝে মধ্যে কবিদের সম্মেলন সাহিত্যিকদের অনুষ্ঠানের সংবাদ কাগজে দেখা যায়। সেগুলো ব্যয়বহুল হোটেলে অথবা জনগণের দুরধিগম্য অন্য কোনো স্থানে। এই জাতীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে লেখক সাহিত্যিকেরা সমাজে প্রমাণ করতে চান তারাও দামী লোক। কিন্তু যে মনোবৃত্তির কারণে গোটা দেশ এবং দেশের মানুষের দিকে পিঠ দিয়ে এই ধরনের সভার আয়োজন করা হয় তা অত্যন্ত সংকীর্ণ, তাই নিন্দনীয়। যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে কাগমারীতে একটা সাহিত্য সম্মেলনের কথা শুনেছি। এই সুদীর্ঘ সময়ের পরিসরে আর ঐ জাতীয় সভা বা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়নি।
তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ পড়বেন কি পড়বেন না, বর্ণমালার সংস্কার হবে কি হবে না ইত্যাদি বিষয়েও পণ্ডিতজনেরা খুব ক্ষুদ্র আকারে হলেও নিজেরা একত্রিত হয়েছেন, মতামত রেখেছেন এবং গোটা জাতির কাছে এই গ্রহণ বর্জনের কথা স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এই ধরণের অনুষ্ঠানগুলো আত্মরক্ষামূলক, আত্মবিকাশের কিছু নেই । সামরিক সরকারকে খুশী করার জন্য সরকারী উদ্যোগে অনেক সভা-সমিতি হয়েছে, সেগুলোতে আমাদের সংস্কৃতির বিরোধী ব্যক্তিবৃন্দই বক্তা এবং সভাপতির আসন অলংকৃত করেছেন। জনগণ ওসব উদ্যোগ আয়োজনকে সব সময়ে ঘৃণার চোখেই দেখেছেন।
বাঙলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে উচিত ছিলো নানা বিষয়ে অনেকগুলো সাময়িক পত্রের আত্মপ্রকাশ। কিন্তু তা হচ্ছে না, বিনিময়ে কোলকাতার পত্র পত্রিকা এসে আমাদের বাজার ছেয়ে ফেলেছে। আমরা কোলকাতার পত্র পত্রিকা আসার বিরোধী নই । কিন্তু কোলকাতার পত্র পত্রিকার আমাদের বাজারে এই একাধিপত্য মারাত্মক। তার দুটি কারণ। প্রথমতঃ কোলকাতার পত্র-পত্রিকাগুলোতে যে ধরনের চিন্তা চেতনার প্রকাশ পায় এবং যে ধরনের সমাজ আদর্শের ছবি তুলে ধরে, সে ধরনের সমাজ আমাদের জনগণের স্বার্থ বিরোধী। তাই এক ভাষা-ভাষী অঞ্চল হলেও আমাদের সমস্যা এবং পশ্চিম বাঙলার সমস্যার ধরনটি এক নয়। দ্বিতীয়তঃ ওদেশের সব পত্র পত্রিকা ব্যাপক হারে আমাদের দেশে আসতে থাকলে আমাদের দেশে সাময়িক পত্রের জন্ম এবং বিকাশ অনেক কারণে বিঘ্নিত হবে। আমাদের প্রতিভাবান এবং প্রতিশ্রুতিবান লেখক সাহিত্যিকেরা পূর্বসংস্কারের বশে কোলকাতার কাগজে লেখা প্রকাশ করবেন এবং কোলকাতার কাগজগুলো বাজার রাখার কারণ কিছুসংখ্যক লেখকের লেখা প্রকাশ করবেন। তার ফল দাঁড়াবে আমাদের দেশে চিন্তাসমৃদ্ধ, সৃষ্টিধর্মী কাগজের প্রকাশ বিলম্বিত হবে। আমাদের সব সমস্যা তো আর কোলকাতার কাগজে আলোচিত হতে পারে না, কারণ কোলকাতার নিজস্ব সমস্যা রয়েছে। আমাদের সাময়িকী আমাদের নিজেদের জন্ম দিতে হবে এবং আমাদের লেখক নিজেদের সৃষ্টি করতেই হবে। প্রথম দিকে হয়তো আমাদের লেখকেরা অপূর্ণ থেকে যাবেন। প্রচেষ্টা আন্তরিক এবং শক্তিমন্ত হলে সে অভাব কাটিয়ে উঠতে পারবে। নবজন্মের সময় সবদেশে তো এমন হয়েছে।