.
০৩.
‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাসে’ তৎকালীন রাজনীতির ভালো মন্দ সম্পর্কে কোনো আলোচনাই করা হয়নি। কারণ এ ব্যাপারে আমার মনে সংশয় ছিলো। সেই পরিবেশ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের চরিত্র আলোচনার সুযোগও ছিলো না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির চরিত্র কি হবে জন্মলগ্নে তার একটি পরিচয় নির্ণয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিলো। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্ম নিরপেক্ষতা এ চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো। বাংলাদেশের তৎকালীন সমাজের বাস্তব অবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় আদর্শের ফাঁকা বুলির মধ্যে পার্থক্যের পরিমাণ এতো অধিক ছিলো যে এক বছর সময়ের মধ্যেই আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছিলো, এ জিনিশ চলবে না, চালানো যাবে না। একটা বিপত্তি ঘনিয়ে আসছে। বাতাসে আমি তার গন্ধ শুঁকেছিলাম। কার্যকারণ সম্পর্ক বিচারের অবকাশ হয়নি। একজন লেখক হিসেবে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে এই সমূহ সর্বনাশের সংকেত আমার মনে জ্বলে উঠেছিলো।
পরবর্তীতে অল্পদিন না যেতেই দেখা গেলো শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধান পরিবর্তন করে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর স্থলে রাষ্ট্রপতি হয়ে বসলেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের পন্থা পরিহার করে একদলীয় শাসন কায়েম করলেন। তারপর মুজিবের শাসন তিন বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তিনি সপরিবারে মর্মান্তিকভাবে নিহত হলেন। একজন বা একাধিক ব্যক্তির হত্যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের পরিচয় পাল্টে যাওয়ার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে অধিক নেই । অথচ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই ব্যাপারটিই ঘটেছে। সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার এই প্রত্যয় দুটো সংবিধান থেকে ঝরে পড়লো। বেশ কিছুদিন সামরিক শাসন চালু থাকার পর জিয়াউর রহমান যখন পুনরায় বহুদলীয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করলেন, সংবিধানের শিরোভাগে বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম এসে স্থান করে নিলো। রাষ্ট্রের চরিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটে গেলো। জিয়াউর রহমনের পর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এসে ইসলাম ধর্মকে বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে বসলেন।
মুজিব পরবর্তী বাংলাদেশের শাসকবৃন্দ ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্রীয় সংবিধানের মধ্যে যেমন পরিবর্তন এনেছেন, তেমনি রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প-বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা এগুলো ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেয়ার প্রক্রিয়া চালু করেন। জিয়াউর রহমান তার শাসনামলে শিল্প প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির হাতে ছেড়ে দেয়ার প্রক্রিয়াটি শুরু করেন। এরশাদের আমলে এসে সেই প্রক্রিয়াটিই অত্যন্ত জোরে-শোরে অনুসৃত হতে থাকে। সামরিক শাসক এরশাদের পতনের পর জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে খালেদা এলেন। খালেদাকে পরাজিত করে হাসিনা। এই বারংবার ক্ষমতার হাত বদলের মধ্যেও রাষ্ট্রীয় পুঁজি ব্যক্তির হাতে স্থানান্তরের প্রক্রিয়াটি প্রতিটি নতুন সরকারের আমলে অধিকতরো বেগবান হয়েছে। বর্তমান শেখ হাসিনার আমলেও যে অল্পস্বল্প পুঁজির নিয়ন্ত্রণভার সরকারের হাতে আছে, ব্যাংক-বীমা ইত্যাকার যে প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক খোদ সরকার, সেগুলো ব্যক্তি মালিকদের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আই এমএফ, বিশ্বব্যাংক এই সমস্ত আন্ত র্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান নিরন্তর চাপ প্রয়োগ করে আসছে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির আসল স্বরূপ নিয়ে যে বিতর্ক সাম্প্রতিককালে কতিপয় জাতীয় প্রতীককে ঘিরে ঘনীভূত হয়েছে মোটা দাগে সেগুলো এরকম। জাতি হিসেবে বাংলাদেশীদের পরিচয় কি হবে? বাঙালী না বাংলাদেশী? বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের পরিচয় মুসলমান না বাঙালী? বাংলাদেশীরা জয়বাংলা বলবে না বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলবে, শেখ মুজিবুর রহমান যার নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সংগ্রাম ধাপে ধাপে বিকশিত হয়ে স্বাধীনতা সগ্রামে রূপ লাভ করেছে, কোন পরিচয়ে তাকে চিহ্নিত করা হবে? তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রের স্থপতি? নাকি বাঙালী জাতির জনকের অভিধায় চিহ্নিত হবেন? বর্তমান বাংলাদেশের দুটি প্রধান দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জতীয়তাবাদী দল এই সমস্ত প্রতাঁকের মধ্যেই তাদের অন্তর্গত বৈপরীত্য এবং মতাদর্শগত বিরোধ সন্ধান করছে । যে প্রতীকগুলো নিয়ে দুটি প্রধান দলের মধ্যে বিরোধ বিসংবাদ চলছে, সেই প্রতীকগুলোর ভাবার্থ এবং গভীর ব্যঞ্জনা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে খতিয়ে দেখলে কোনো বৈপরীত্য আবিষ্কার করা সত্যি সত্যি অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। আমরা বাঙালী একথা যেমন সত্য, তেমনি আমাদের বাংলাদেশী পরিচয়ও মিথ্যা নয়। সংখ্যাধিক জনগোষ্ঠীর মুসলমানিত্বের পরিচয় বাঙালীত্বের পরিচয় খারিজ করে না। জয় বাংলা এবং জিন্দাবাদ শব্দটির মধ্যে অর্থগত কোনো বিরোধ না থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় জয়বাংলা শব্দবন্ধটি একটি বিশেষ তাৎপর্য লাভ করেছিলো, সেকথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। যেহেতু আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতৃত্বের দাবীদার, সেই সুবাদে জয়বাংলা শব্দবন্ধটি তাঁরা একচেটিয়াভাবে ব্যবহার করে থাকেন। অন্য কোনো ব্যক্তিবর্গ যদি আওয়ামী লীগ বিরোধী একটি রাজনৈতিক সংগঠন দাঁড় করিয়ে জয়বাংলা শব্দটিকে ব্যবহার করতে থাকেন, আওয়ামী লীগের তরফ থেকে আপত্তি উত্থাপন করার কোনো কারণ কি থাকতে পারে? যদি বাংলা ভাষার শব্দ হওয়ার কারণে জিন্দাবাদের বদলে জয় বাংলার গ্রহণযোগ্যতা অধিক হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে, আওয়ামী লীগ শব্দবন্ধটিও বাংলা নয়। আওয়ামী শব্দটি উর্দু এবং লীগ শব্দটি ইংরেজী । তারপরে শেখ মুজিবুর রহমানের কথা ধরা যাক। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি না বাঙালী জাতির জনক? মুজিবকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে মেনে নিলে কারো কোনো বিতর্কের অবকাশ থাকে না। কিন্তু তাঁকে বাঙালী জাতির জনক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে আরো একটি প্যাচালো বিতর্কের জন্ম দেয়া হয় মাত্র। বাংলাদেশের বাইরে ভারতের নানা জায়গায় বাঙালীরা বসবাস করে থাকেন। তারা শেখ মুজিবকে বাঙালী জাতির জনক হিসেবে মেনে নিতে স্বীকৃত হবেন না। প্রকৃত অর্থে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ভূখণ্ডটিই স্বাধীন হয়েছে। তাকে যদি জাতির জনক হিসেবে মেনেও নিতে হয়, বাংলাদেশী জাতির জনক বলাই অধিকতররা সঙ্গত। তাই যদি হয়, তাহলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার দাবীই প্রকারান্তরে স্বীকার করা হয় নাকি? বাংলাদেশী বলে কোনো জাতি যেমন নেই, তেমনি কোনো পিতাও থাকতে পারে না।