শেষ পর্যন্ত কি ভিখারীই থেকে যাবো? আমরা কি রাজনীতিতে প্রজ্ঞা এবং ভালোবাসার বদলে ফাঁকিবাজিই করে যাবো? সরকারের নামে নির্যাতনেই চলবে এদেশে? বিজ্ঞানের নামে বিদেশের সেকেন্ডহ্যান্ড যন্ত্রপাতি বিক্রয়ের ক্যানভাসার সৃষ্টি হবে? সামাজিকতার নামে তামসিক বৃত্তির চর্চা করবো? সাহিত্যের নামে বাজে কথার আড়ত বানাবো? লোকহিতের নামে জুয়াচুরি করবো? এক অদ্ভুত দেশে আমরা বাস করি। যে দেশে মানুষের সাবালক মস্তিষ্কের ফসল বিজ্ঞান এসেছে অনেকদিন আগে। কিন্তু মানুষের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে আমাদের দেশে ব্যর্থ হয়েছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞান এসেছে বিলাসের উপকরণ হিসেবে, শোষণের হাতিয়ার হিসেবে। আমাদের দেশের জীবন সুখী এবং সুন্দর করার বদলে হতশ্রী এবং হতাশায় ভরিয়ে তুলেছে। আধুনিক মানববাদী শিক্ষা আমাদের দেশে এসেছে আমলা সৃষ্টির ফুস মন্তর হয়ে। পৃথিবীর অতগ্রসর সামাজিক বিপ্লব এবং রাজনৈতিক সংগ্রামের আগ্নেয় চেতনা আমাদের দেশের ঘাটে এসে তুকতাক বশীকরণ বিদ্যার আকার ধারণ করেছে।
সবচে’ আশ্চর্যের বিষয় আমাদের জ্ঞানীগুণীজন কবি সাহিত্যিক শিক্ষক সাংবাদিকদের মন এসবে মোটেই খোঁচায় না। প্রতিটি সরকারের আমলে সকলে তাকে ঠুকে বলেন খোদার দুনিয়ার এই অংশ আপনার সুশাসনে বহাল তবিয়তে চলছে। সমাজের তলা পর্যন্ত অবলোকন করে সারবান কিছু বলেছেন, বা লিখেছেন এমন মানুষ আমাদের সমাজে নেই বললেই চলে। যাদের ভাবার দায়িত্ব, তাদের ভাবনা যন্ত্র বিকল। প্রয়োজন কতোদূর, ঘা কতোবড়ো সে বিষয়ে কোনো অনুভূতি নেই। একটি জাতি তার প্রয়োজন, অপ্রয়োজন, অজ্ঞতা, মূর্খতা ইত্যাদি নিয়ে ভাবতেই যদি না পারে তার কিসের গণতন্ত্র? গালভরা নাম দিলে তো আর সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। ভিক্ষাজীবী, পুঁজিবাদ, ভিক্ষাজীবী পরাধীনতা আর ভিক্ষা নির্ভর সমাজতন্ত্রে পার্থক্যটা কোথায়? সমাজতন্ত্রের মূল কথা মানুষকে ভেতর থেকে আত্মশক্তিতে আস্থাশীল করা, সৃজনী শক্তিতে এবং সহযোগীতায় বিশ্বাস করা। মানুষের সৃষ্ট সমস্ত কৃত্রিম বিভেদকে গুঁড়িয়ে ফেলে মানুষে মানুষে মিলনের পথ প্রশস্ত করা; সর্বপ্রকার দাসত্ব থেকে মানুষী সত্তা যা সভ্যতার প্রাণবস্তু তাকে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন এবং আপন ক্ষেত্রে স্থিত করা। বাঙলাদেশে সে প্রক্রিয়াটি কি শুরু হয়েছে? বেতার টেলিভিশন সংবাদপত্রে বলা হচ্ছে হাঁ শুরু হয়েছে। কিন্তু তাও অন্যান্য দেশের অন্ধ অনুকরণ করে বলা হচ্ছে। তার সঙ্গে বাস্তবের কোনো সংযোগ নেই।
সমাজতন্ত্রের কবি কই? ভাবুক কই? চিত্রকর কোথায়? কোথায় মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বিনাশকারী কুসুমসদৃশ কোমল বজ্ৰাদপি কঠোর মানবপ্রেমিক সংগ্রামী? কোথায় আত্মপর ভেদহীন জ্ঞানমিশ্রিত কর্মীর বাহিনী? এসব কিছুই নেই-তবু সংবিধানের ঘোষণাতে সমাজতন্ত্র এসে যাবে–সে ভারী আজব কথা। আজকের এই পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের মানুষদের একটি মাত্র কর্তব্য হওয়া উচিত। সে যেখানে যে দেশকে ভালোবাসে, সংস্কৃতি ভালোবাসে, মানুষ ভালোবাসে, জ্ঞান ভালোবাসে; সকলে মিলে জ্ঞানের ভবিষ্যৎ, মানুষের সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ এবং দেশের ভবিষ্যৎ সুন্দরভাবে রচনা করার কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। কতগুলো বিষয়ে নিশ্চিত ধারণা নেয়া প্রয়োজন। জ্ঞান মানবজীবনকে সুন্দর করে বলেই আকাঙ্খিত। সংস্কৃতিতে জীবনের আশা-আকাঙ্খর স্পন্দন বাজে বলেই বরণীয়। একটা দেশের আধারেই জ্ঞানের প্রসার, সাংস্কৃতিক অগ্রগতি, মানুষের উন্নতি হতে পারে। আন্তর্জাতিক ভিত্তিতেও সে সবের কল্পনা করা যায় । কিন্তু এ পর্যন্ত পৃথিবীর লিখিত ইতিহাসে আন্ত র্জাতিক প্রচেষ্টায় এ জাতীয় প্রমাণ মেলে না। আন্তর্জাতিক সাহায্যের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করে আমাদের ভাগ্য বদলানো সম্ভব নয়। আমাদের দাঁড়াতে হবে নিজের মেরুদণ্ডের ওপর, তাকাতে হবে, নিজেদের দিকে, অনুসরণ করতে হবে নিজেদের সৃজনী শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে দেশের মানুষকে, জাগাতে হবে ঘুমন্ত শক্তি এবং প্রতিভাকে । বড়ো জোড় বিদেশ থেকে প্রেরণা পেতে পারি, দৃষ্টান্তে উৎসাহিত হতে পারি, কিছু উপকরণও আনতে পারি। আমাদের দেশে আমরাই সব। যা কিছু করার আমরাই করবো।
.
সমস্ত কিছুর একটা ভিত্তি, একটা অবলম্বন প্রয়োজন। বাঙলাদেশে যে নতুন সংস্কৃতির রূপরেখা আভাসিত হয়ে উঠেছে, সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক প্রয়োজনে বাঙলাদেশের জনগণের নতুন একটি সংস্কৃতি ক্ষেত্রের দিগন্ত উন্মোচন অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে-তার বস্তুভিত্তি কি? সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন এবং অন্যান্য সুকুমার কলা অনুকুল পরিবেশ না পেলে গড়ে উঠতে পারে না। আশা করতে দোষ নেই, বাঙলাদেশে অনতিবিলম্বে তেমন একটা পরিবেশ তৈরি হবে। কঠোর বাস্তবের দিকে না তাকিয়ে শুধুমাত্র আশাবাদ দিয়ে কোথাও কিছু ভালো কাজ হয়েছে তেমন প্রমাণ নেই। আমাদেরও বাস্তব অবস্থার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করার প্রয়োজন এসেছে। অন্যভাবে বলতে গেলে এরকম দাঁড়ায়, বাস্তব অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, সোজাসুজি না তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।
সংস্কৃতির বাহন পত্রপত্রিকা এবং নানা রকমের সাময়িকী । আজকে বাঙলাদেশে বলতে গেলে কোনো পত্র পত্রিকা নেই যাতে তীব্র জীবনাবেগ, গভীর প্রাণস্পন্দন, পরিণত চিন্তা কিংবা জনগণের কল্যাণ ভাবনার কোনো চিহ্ন ধারণ করে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়। তার ফলশ্রুতি এই হয়েছে, আমাদের এই দেশে মতামতের, ভাবের, অনুভূতির এবং জ্ঞানের চলাচল প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। পণ্ডিত সমাজ একেবারে সমাজের সঙ্গে বাস্তব সংযোগহীন হয়ে পড়েছে। আর পরিণত বুদ্ধি, জীবনের অভিজ্ঞতা এবং প্রগাঢ় জ্ঞানের অভিভাবকত্বে যে নতুন চিন্তার উম্মেষ হয়, প্রবীণের সস্নেহ প্রশ্রয়ে, ঋদ্ধ সমালোচনায় তরুণ তার সাধনার যে সার্থকতা অনুভব করে, তা একেবারেই হচ্ছে না। পণ্ডিতেরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন, তরুণরা কোনো একটা লক্ষ্য ঠিক করতে পারছেন না বলে অনেক ক্ষেত্রে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েন। কর্তব্যাকর্তব্য নির্ধারণ করতে পারেন না। আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে অনেকগুলো সাময়িকপত্র থাকলে পণ্ডিতেরা কিছুতেই বিচ্ছিন্ন থাকতে পারতেন না। তাদেরকে নেমে আসতে হতো, নানান বিতর্কের সম্মুখীন হতে হতো, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক নানা প্রশ্নে মতামত রাখতে হতো। পণ্ডিতবর্গের মতামতের ওপর নির্ভর করে গোটা সমাজে তর্কের তুফান ছুটতো। জাতির মানসূহদে ঢেউয়ের পর ঢেউ খেলে যেতো। এই দ্বন্দ্বে আমাদের সংস্কৃতির ভারজীর্ণ অংশ খসে পড়তো। শুধু প্রাণটুকু তরুণদের মনপ্রাণ লালিয়ে তুলতো। তারা কল্যাণের, সুন্দরের, সত্যের পথে হেলায় দুরূহ সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে পারতেন।