আজ এই দাস্য মনোভাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তা নইলে আমাদের স্বাধীনতা মিথ্যা হয়ে যাবে। কিন্তু এই মানসিক দাসত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কাজটা হৈ হৈ করে হওয়ার কথা নয়। এতে প্রয়োজন সুন্দরতম ধৈর্য, মহত্তম সাহস, তীক্ষ্ণতম মেধা এবং প্রচণ্ড কুলছাপানো ভালোবাসা, যার স্পর্শে আমাদের জনগণের কুঁকড়ে যাওয়া মানসিক প্রত্যঙ্গে আশা-আকাঙ্খ জাগবে এবং সাহস ফণা মেলবে।
.
আমাদের সমাজের দিকে তাকালে একই সঙ্গে লজ্জা, ঘৃণা, এবং অসহায়তা বোধ না করে উপায় নেই। এই যুগে মানুষ চাদে গেছে, সমুদ্রের তলায় ডুবেছে, ক্ষ্যাপা নদীর মাজায় বন্ধনী পরিয়ে ঊষর মরুভূমিকে শষ্য শ্যামলা করেছে। নিপ্রাণ কঠিন আবরণ উপড়ে ফেলে দিয়ে তুষার ঢাকা অঞ্চলে সোনালী গমের ক্ষেত বধুয়ার আঁচলের মতো দুলছে। মানুষের কতো কীর্তি, কতো সম্মিলিত প্রয়াস, কতো অসাধ্য সাধনের কাহিনী আমরা শুনে পাশ ফিরে ঘুমোই। অথচ আমরাও মানুষ । আমাদেরও হাত পা মাথা সব আছে। আমরাও সমাজে বাস করি। আমাদের রাষ্ট্র আছে, সরকার আছে। তবু আমাদের মানুষ হয়েও পশুর মতো জীবন কাটাতে হয়। আমরা গতর খাঁটিয়ে উৎপাদন করতে পারিনে, মাথা খেলিয়ে আবিষ্কার করতে পারিনে, বুক প্রসারিত করে ভাবতে পারিনে। আমাদের এই দেশে আমরা হাত-পা যুক্ত মানুষ হয়েও বিকলাঙ্গ। চোখের সামনে আমাদের কতো কিছু ঘটে যাচ্ছে, কতো নতুন নতুন আবিষ্কারে সমৃদ্ধ হচ্ছে জ্ঞান বিজ্ঞানের ভাণ্ডার, সন্ধানীর স্বচ্ছ দৃষ্টিতে বিজুলীর রেখার মতো কতো তত্ত্ব এবং তথ্য ঝিলিক দিয়ে ধরা পড়ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই বিরাট যজ্ঞে আমাদের কোন স্থান নেই। সমাজ ভেঙে সমাজ গড়ার এই মহান শক্তিমন্ত ক্রীড়ায় আমরা নীরব দর্শকও নই। নতুন সংগ্রামী মানবতার ললাটে বিজয় মুকুট পরাবার কাজে এক পা এগুই তিন পা পিছিয়ে যাই।
আমাদের সমাজে দৈব এবং দুর্দৈব রাজত্ব করছে। প্রবল পক্ষ দুর্বল পক্ষের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে। গোটা দেশব্যাপী বিচারের বাণী নীরবে নিভৃত অশ্রুপাত করছে। দয়া, মানবতা, প্রেম, করুণা এসব শব্দ এখন অন্তর্নিহিত ব্যাঞ্জনা হারিয়ে ফেলেছে। শঠতা, মিথ্যাচার এবং প্রবঞ্চনা এদেশের রাজনৈতিক আন্দালনের মূলধন। তামসিক প্রবৃত্তির পরিচর্যা এদেশে ধর্মীয় কর্তব্যের অঙ্গীভূত বিষয়। সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা এদেশের নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রবল পক্ষের স্থূল অসহিষ্ণু সাম্প্রদায়িকতা এবং দুর্বল পক্ষের নিষ্ক্রিয় বিদেশে সহানুভূতি যাঞ্চাকারী সাম্প্রদায়িকতা এবং দেশের ঐতিহ্যিক সম্পত্তি । আবার প্রবল পক্ষ এবং দুর্বল পক্ষ, হিন্দু-মুসলমান দুই-ই মিলে দুর্বলতরো পক্ষ মগ, হাজং, গারো, চাকমা প্রভৃতি সব উপজাতিদের বুকের ওপর চেপে বসে আছে । আমাদের এই দেশে ধর্মের নামে ধর্মধ্বাজীরা রায়ট করে। জ্ঞানের নামে পণ্ডিত নামধারী মানুষেরা চাতুরী করে, সত্য, সুন্দর এবং মঙ্গলের নামে কবি-সাহিত্যিক এবং চিন্তাশীল মানুষরা চাতুরালী করে। রাজনীতির নামে লোক ঠকায়। কুসংস্কার মানুষের মনে মনে বন রচনা করেছে। কাঁপালিক প্রবৃত্তির গোঁড়ায় জল ঢেলে, সার দিয়ে রাজনীতির সেনাপতিবৃন্দ খেয়া ঘাট পার হবার জন্য নিত্যনতুন চকচকে কৌশল রচনা করেন। হয়তো তারা নির্বাচনের খেয়া খুব ধুমধাম করে পার হয়ে যাবেন। কিন্তু তারপর? তারপরও তো বাঙলাদেশে মানুষ থাকবে। সে মানুষদের কি হবে? যাদের দেখে প্রাচীন যুগে চর্যাপদের কবি বলেছিলেন, হাড়িতে ভাত নেই, তাই নিত্য উপবাস করতে হয় এবং মধ্যযুগে চণ্ডী-মঙ্গলের কবি বলেছেন, “শিশু কাঁদে ওদনের তরে, বাঙলাদেশে প্রাচীন ও মধ্যযুগ যুগপৎভাবে অবস্থান করছে। এখনো হাড়িতে ভাত থাকে না, গেরস্থ নিত্যি উপোষ দেয়, এখনো শিশু এক ফোঁটা দুধের জন্য আছালি পিছালি করে। সেই চাষা, সেই লাঙ্গল, সেই বলদ, সেই সংস্কার, ক্ষুধা, সেই, রোগ, সেই অভাব, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর বাঙলাদেশের ললাটের অক্ষয় লিখনের মতো অটুট হয়ে আছে। সব পর্যায়ক্রমে একের পর এক দর্শন দিয়ে যায়। বন্যা, জলোচ্ছাস এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ঝড়-ঝঞ্জ ঘরদোর তছনছ করে ফেলে। বনের পশুরাও অনেক দ্র জীবন যাপন করে। তারপরেও বাঙলাদেশের মানুষ বেঁচে থাকে। তাদের জীবনী শক্তি এতো শক্ত। বাঙলাদেশের নারী সমাজের কথা কয়ে লাভ নেই। ঊনবিংশ শতাব্দীর মনীষীবৃন্দ বাঙলাদেশের নারীদের দুঃখ–দুর্দশার কথা স্মরণ করে চোখের জল ফেলেছিলেন। এখন চোখের জলও ফুরিয়ে গেছে। তবু সে সহিষ্ণুতায় বাঙালী নারীর স্বামী পুত্রের সংসার রক্ষা করে, সন্তান ধারণ করে এবং রোগ শোক মারীর আক্রমণ এড়িয়ে বাঁচিয়ে রাখে সন্তান তা পারমাণবিক বিদ্যার চাইতেও দুরূহ এবং জাটিল সাধনার বলেই সম্ভব। নারীমুক্তি, নারী জাগরণ, নারী আন্দোলন ইত্যাদি সব শব্দ কিষাণের কুটিরে, জেলে, তাঁতী, ছুতোর, কামারের ভেঙ্গে পড়া আটচালায় কেমন ইংরেজী শোনায় না?
অনেকগুলো অভুক্ত সন্তান যে রকম করে জননীর স্তনের বোটা আকর্ষণ করে মারা মারি কামড়া-কামড়ি করে কিন্তু কারো পেট ভরে না, তেমনি আদ্যিকালের উৎপাদন পদ্ধতি অনুসারে আদ্যিকালের যন্ত্রপাতি নিয়ে কোটি কোটি মানুষ জমির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। কারো ক্ষুধা মেটে না। এতো মানুষের পেটের ভাত যোগাবার ক্ষমতা জমির নেই। তাই মানুষ আত্ম-ধ্বংসী কলহে রত হয়। কিন্তু মানুষ যাবে কোথায়? আমাদের দেশে কল নেই, কারখানা নেই, বিশ্বজোড়া আমাদের কারবার তেজারতি কিছু নেই। অদূর ভবিষ্যতে যে হবে তার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই আমাদের জাতীয় পেশা ভিক্ষা। ফরেন এডে’র দিকে আমরা হা-পিত্যেশ করে চেয়ে থাকি। বিদেশী সাহায্য খেয়ে খেয়ে আমাদের হজম শক্তি অনেক গুণ বেড়ে গেছে। এক দেশের ভিক্ষা নেয়ার পর আরেক দেশের দিকে হাত বাড়িয়ে বাঙালী কাঙালী প্রবাদের সার্থকতা প্রমাণ করি। সেই বিদেশী সাহায্য আমাদের দেশের অতি খাওয়া লোকেরা উদরসাৎ করে, অভূক্তদের কাছে পৌঁছায় না। আমাদের জাতীয় মুলধন হতাশা। বেশী খাওয়া এবং একেবারে না খাওয়ার হতাশার পীড়নে আমাদের সমাজ উত্থান শক্তিহীন। আমাদের সমাজে অফুরন্ত শক্তি এবং অনন্ত সম্ভাবনার আধার অমৃতের পুত্র, অমৃতের সহোদর মানুষের জীবনই সবচাইতে ঘৃণিত, অবহেলিত এবং অনিশ্চিত। সর্বক্ষেত্রে জীবন লাঞ্ছিত, অপমানিত এবং নিগৃহীত হচ্ছে। পৃথিবীর কোনো দেশে মানুষ এমনি করে তারই ভাই মানুষের হাতে মার খায়? মার খেয়ে সহ্য করে? পৃথিবীর কোনো দেশে মানুষ শুভবুদ্ধির প্রতি এমন কঠিন ব্যঙ্গবিদ্রুেপের বাণ নিক্ষেপ করে? পৃথিবীর কোনো দেশে মানুষের অধিকার মানুষ এমনি করে হরন করে? পৃথিবীর কোনো দেশে মানুষের ভবিষ্যতের আশার মুকুল এমনি করে ঝরে যায়? অকাল জীবনতরু মরে যায়? কল্পনার পাখি পাখা অচল হয়? যদি কোনো দেশে হয় সে আমাদের দেশ-আমাদের প্রিয় কবি কল্পচোখে যার রূপ দেখে গান বেঁধেছেন সোনার বাঙলা… । দুনিয়ার সব কিছুর অদল বদল হয়ে গেছে। দেশে দেশে পালা বদলের পালা সূচিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের সোনার বাঙলা বালুচরে আটকে পড়া নায়ের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। রাজা এসেছে, রাজা গিয়েছে। কতো আন্দোলন গতিবেগ সঞ্চয় করে জলস্তম্ভের মতো ফুলে ফুলে উঠলো । কতো নেতা এলেন গেলেন, কতো আশা উদ্যম, স্বপ্ন-সাধনার অপচয় হলো কিন্তু মানুষের ভাগ্য ফিরলোনা-এমনি দেশে আমরা বাস করি। রাগে দুঃখে, ক্ষোভে, অপমানে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হয়। অন্যায়ের ওপর ভিত্তি করে শাসকদল টিকে থাকে আবার অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেই বিরোধী দল ক্ষমতা দখল করে। যতোই ভাবি অসংখ্য মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে মুষ্টিমেয় মানুষের এই ছিনিমিনি খেলা তার বুঝি কোন অবসান নেই ।