জ্ঞান সার্বজনীন। কিন্তু দেশে দেশে তার বিকাশ এবং প্রয়োগ বিধি একেক রকম। কিন্তু এই বোধটা আমাদের নেই, কেননা আমাদের অনুভূতিশক্তি খুবই ভোতা। তাই আমাদের শহুরে স্থাপত্যের দিকে তাকালে এক নিমিষে মনে পড়ে যায় একেক খণ্ড বিলেত আমেরিকা আমাদের দেশে উড়ে এসে জুড়ে বসে গোটা দেশের উত্থান শক্তি রহিত করে রেখেছে। বিলেত আমেরিকায় স্থাপত্য কলা খারাপ কিংবা অবিকশিত বলার ইচ্ছে আদৌ আমাদের নেই। বরং আমরা বলতে চাই, ওসব দেশে স্থাপত্য কলার প্রভূত উন্নতি হয়েছে, কিন্তু উন্নত স্থাপত্যের অনুকরণ করার মধ্যে আমাদের প্রকৌশলীদের মৌলিক শক্তির পরিচয় নেই। আমরা যে অনেক অনেক পশ্চাদপদ তার প্রমাণ আমাদের সাধনা থেকে কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, আধুনিক কোনো দার্শনিক সূত্র, সমাজতাত্বিক গবেষণা কিংবা অন্য কোনো রকমের কলা বা জ্ঞানের উদ্ভব হয়নি-অদুর ভবিষ্যতে যে হবে তার কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।
আমাদের এই দেশে মজার কথা হলো, যাদের এসব বিষয়ে ভাবার দায়িত্ব তাঁরাই মানসিকভাবে বিদেশের দাস হয়ে পড়েন। বিদেশের ভালো কিছু গ্রহণ করার মধ্যে কোনো যে দোষ আছে, তেমন কথা বলছিনে। কিন্তু বিদেশী সব কিছু আমরা দাসের মতো গ্রহণ করবো, না স্বাধীন মানুষের মতো গ্রহণ করবো পুরোপুরি নির্ভর করছে। আমাদের ইচ্ছার উপর। আমাদের ইচ্ছাটাও দেখতে হবে। এটি ব্যক্তিগত ইচ্ছা কি সামাজিক ইচ্ছা, তার চারিত্র্য নির্ধারণ করাও প্রয়োজন। কোনো লোক রসায়ন বিদ্যায় জ্ঞান লাভ করতে চাইলে জ্ঞান লাভ করতে পারেন। সে জন্য রসায়ন শাস্ত্রের গ্রন্থাদি পড়তে হবে। সেগুলো বাঙলা ভাষাতে নেই। সে জন্য তাঁকে ইংরেজী, ফরাসী, জার্মান শিখতে হবে । এদেশে গবেষণাগার এবং উপযুক্ত শিক্ষক নেই। সে জন্য তাকে সেসব দেশে যেতে হবে। কিন্তু একটা জাতির যদি হাজার হাজার রসায়নবিদের প্রয়োজন পড়ে তাহলে সকলকে প্রতিবছর জার্মানীতে, ফ্রান্সে, আমেরিকায়, রাশিয়ায় পাঠানো অসম্ভব। সে জ্ঞান–যাতে বিদেশীরা সাফল্য লাভ করেছেন, যে কোনো মূল্যে, যে কোনো শ্রমে, যে কোনো ত্যাগে এবং তিতিক্ষায় বাঙলা ভাষায় নিয়ে আসতে হবে, বাঙলাদেশে গবেষক এবং গবেষণাগার সৃষ্টি করতেই হবে। এই পদ্ধতিতেই জ্ঞানের সামাজিকীকরণ করা হয়। এ পর্যন্ত এদিক দিয়ে আমাদের দেশ এক পা-ও অগ্রসর হয়নি।
আমাদের অর্থনীতির পণ্ডিতেরা হার্ভার্ড থেকে যে অর্থনীতি শিখে আসেন তার প্রয়োগ আমাদের দেশে সম্ভব নয়। অক্সফোর্ড থেকে যে সমাজতত্ত্বের পাঠ নিয়ে আসেন বাঙলাদেশে তা অনেকটা মূল্যহীন। হার্ভার্ড-অক্সফোর্ডের শিক্ষা-দীক্ষা, গবেষণা ইত্যাদি অনেকটা ইংরেজ মার্কিন সমাজের অভিজ্ঞতা, উদ্দেশ্য শক্তি এবং বাস্তবতা দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। বাঙলাদেশে তা প্রয়োগ করা নানা কারণে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তার ফলেই আমাদের পণ্ডিতেরা অনেক সময় বিদেশী বিদ্যার ভারবাহী পশুতে পরিণত হয়ে যান। যে বিদ্যার ফলিত প্রয়োগ নেই বা প্রয়োগের ক্ষেত্র অন্বেষণের ব্যাকুলতা নেই সে শিক্ষিত মানুষও এক ধরণের ভারবাহী পশু।
আমাদের দেশে অনেকদিন থেকে এ চলে আসছে এবং এখনো চলছে। তার কারণ এই শিক্ষিত শ্ৰেণীটিই নানাদিক দিয়ে নিয়ন্ত্রিত করেছে আমাদের সমাজকে। তারাই রাজনীতির হর্তাকর্তা, তারাই জাতির ভাগ্য বিধাতা। নিজেরা বহাল তবিয়তে বেঁচে থেকে সমস্ত দেশের মানুষ মরুক, বাঁচুক, জাহান্নামে যাক কিংবা অশিক্ষিত থেকে যাক তাদের কিছু আসে যায় না। আপন পাওনাগণ্ডা পেলেই তারা খুশী । এই সন্তুষ্ট শ্রেণীর অবিমৃষ্যতার দরুণই পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসন এতো দীর্ঘকাল স্থায়ী হতে পেরেছে। জ্ঞানই শক্তি-এ অনুভূতি তাদের মন মানসে কদাচিৎ জেগেছে। তারা উপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের লেজুর ছিলেন, তাদের মাধ্যমেই বিদেশী শোষকেরা এ দেশের মানুষকে শোষণ করতো এবং তারা নিজেরাও প্রত্যক্ষভাবে শোষণ করতেন। তাদের নিজেদের প্রয়োজন মতো জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সংস্কৃতি সবকিছুর উদ্ভব হতে পারে।
আমাদের মন মানস এতো দীর্ঘকাল ধরে দাসত্ব করেছে যে, তার হদিস আমরা নিজেরাও জানিনে। অসংখ্য বিদেশী জিনিশের মধ্যে কোনটা আমাদের জন্য উপযুক্ত, কোনটা অনুপযুক্ত, কোনটা প্রয়োজন, কোনটা অপ্রয়োজন, কোনটা খেতে ভালো হবে, কোনটা খেলে খারাপ হবে, কোনটা করা উচিত, কোনটা করা উচিত নয় সে ব্যাপারে আমাদের ধারণা করার শক্তিও নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা জ্ঞানকে কতোদূর সার্বজনীন করবো, প্রযুক্তি বিদ্যার কি পরিমাণ প্রসার ঘটাবো এবং ফলিত বিজ্ঞানের বিকাশ কতোদূর নিশ্চিত করবো তার উপরেই নির্ভর করছে আমাদের স্বাধীনতার ভাবষ্যৎ। এসব যদি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে তাহলে নামে স্বাধীন হলেও কার্যত আমাদের দাস থেকেই যেতে হবে। অপরের বাধাধরা চিন্তার মধ্যে আমাদের আবর্তিত হতে হবে । আমাদের নিজস্ব রুচী নিজস্ব সংস্কৃতির যে নির্দিষ্ট কোনো আকার আছে, তা কোনদিন দৃশ্যমান করে তুলতে পারবো না। বাঙালী সংস্কৃতি বলতে যদি আদ্যিকালের কোম সমাজের চিন্তা-চেতনায় আচ্ছন্ন থাকি বা তা আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করি তাহলে আমরা সভ্য মানুষ হিসেবে স্বীকৃত হতে পারবো না। ইতিহাসের ধারায় বাঙালী আজ যেখানে এসে পৌঁছেছে সব কিছুকে স্বীকার করে নিয়ে, মেনে নিয়ে এই বৈজ্ঞানিক যুগে পৃথিবীর অপরাপর দেশের সঙ্গে তাল রেখে আমাদের মাটি জলহাওয়া যে আমাদের চরিত্রকে একটি নির্দিষ্ট ধাচে তৈরি করেছে, সেটি ফুটিয়ে তুলতে পারাটাই হবে আমাদের যথার্থ মৌলিকতার স্ফুরণ। এবং সেটাই হবে আমাদের যথার্থ বাঙ্গালীয়ানা।