আমাদের প্রবীণ সংস্কৃতি বিশারদরা তাঁদের অভিজ্ঞতার দোহাই পেড়ে বিপদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে চান। যারা এ বিপদকে সোজাসোজি চ্যালেঞ্জ করতে চান, তাদেরকে হঠকারী ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে সম্ভাব্য সকল উপায়ে বিরোধিতা করছেন। যে ক্ষেত্রে তারা সরকারী কর্মচারী, পদস্থ অফিসার সরকারের আইন দেখিয়ে চিন্তার স্রোত, জীবনের উল্লাস এবং কল্পনার দাবীকে লৌহ শৃঙ্খলে আটক করে রাখতে চাইছেন-এই সময়েই তরুণদের বিদ্রোহ করার সময়, ভবিষ্যতের সুন্দর স্বপ্নের দিকে দৃষ্টি রেখে নৈরাজ্যের আওতা থেকে বেরিয়ে পড়ার সময়। প্রবীণ পদস্থ ভদ্রলোকেরা যে অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে চোখ রাঙাচ্ছেন, সে তাদের সুদীর্ঘ জীবনের দাসত্বের অভিজ্ঞতা। এই মানসিকভাবে দাস সংস্কৃতিজীবীদের হাতে এতোকাল আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতির ভার ন্যস্ত ছিলো বলেই আমাদের শিক্ষা, আমাদের সংস্কৃতিতে জাতীয় মানসের আশা আকাঙ্খ প্রতিফলিত হয়নি।
এই নৈরাজ্য, এই বিশৃঙ্খলা কিছুতেই আমাদের সমাজের শেষ কথা নয়। এই নৈরাজ্যের মধ্যেই মহত্তরো সম্ভাবনার ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে। এই ভাঙনের কুলেই আভাসিত হবে নতুনের। আমাদের সমাজ যে ভাঙছে, আমাদের চিন্তাতে যে ঘূর্ণিস্রোত সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে মহত্তরো সামাজিক সম্ভাবনা যারা দেখতে চান না তাদের চিন্তা কিছুতেই সঠিক চিন্তা হতে পারে না। আমাদের দেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়-এই শান্তিপ্রিয় মানুষগুলো ক্ষেপে উঠেছেন। তাদের পেটে ভাত নেই, পরনে কাপড় নেই, শরীরে স্বাস্থ্য নেই, রোগের ওষুধ নেই, জীবন এবং জীবিকার নিশ্চয়তা নেই। এ সবের দাবীতে তারা ক্ষেপে উঠেছেন। সে সমস্তের ব্যবস্থা করা হোক, তারা আপনা থেকেই ঠাণ্ডা হয়ে যাবেন। যদি বলা হয় আমাদের মতো গরীব দেশে এতোসবের একসঙ্গে নিশ্চয়তা বিধান করা এতো সহজ নয়। তাহলে কথা দাঁড়াচ্ছে, এদেরকে তুমি নিশ্চয়তা দিতে পারছে না, কিন্তু নিশ্চিতভাবে একটা শ্রেণী কি ভাবে আরো ধনী হয়ে যাচ্ছে। এই ধনী হওয়ার নিশ্চয়তা তারা পেলো কোথায়? ধনীদের টাকা কার ব্যাংকে জমা থাকে? ধনীদের কলকারখানায় কারা পাহারা দেয়, কারা খাটে? বিচারে ধনীদের কারা জিতিয়ে দেয়? যদি বলো আগে থেকে এমন হয়ে এসেছে, বৃটিশ আমলে এমনও এমন ছিলো, এখনো এমন চলছে, করার কিছু নেই। এ তোমার মনগড়া কথা। বৃটিশ আমলে বৃটিশ গভর্ণর ছিলো, পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানী একনায়ক ছিলো, আর আমাদের আমলে আমরা তোমাকে জিম্মাদার করেছি এবং করছি এই জন্যে যে বৃটিশ আমলের সমাজটাকে তুমি ভেঙ্গে ফেলবে, পাকিস্তান আমলে সৃষ্ট আমলাতান্ত্রিকতার কাঠামোটা সম্পূর্ণ বদলে দেবে। তা না করে তুমি যদি সেই বৃটিশ এবং পাকিস্তানী আমলের প্রভূদের মতো ব্যবহার করো, তাদের সৃষ্ট আমলা এবং অনুচরদের নিজের চারদিকে বডি গার্ড রাখো অথবা নিজে একদল অনুরূপ বানিয়ে নাও এবং কারণ অনুসন্ধান না করে উপযুক্ত সামাজিক প্রতিবিধান করার বদলে নিজেই হুঙ্কার ছাড়তে থাকো এবং নৈরাজ্যের শক্তি বাড়িয়ে তোলো–সেটা আমার জাতির সর্বাঙ্গীণ বিকাশের পক্ষে ক্ষতিকর, একথা দ্বৰ্থহীন ভাষাতে ঘোষণা করবো।
রাজনৈতিক সংগ্রামকে স্বাভাবিক পরিণতির দিকে এগিয়ে নেয়ার প্রয়োজনের সঙ্গে সংস্কৃতির সগ্রামকেও এগিয়ে নিতে হবে। সুস্থ রাজনৈতিক সংগ্রাম ছাড়া সুস্থ সংস্কৃতি কখনো আশা করা যায় না। সুস্থ সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে যারা আশা রাখেন তাদের গৌণ কাজ হওয়া উচিত রাজনৈতিক সংগ্রামকে বিকশিত হতে সাহায্য করা। আমাদের দেশে অনেক প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বর্তমানে বক্তব্যহীন হয়ে পড়েছেন, তার কারণ হালের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে চরম এবং পরম মনে করেছেন। সে সঙ্গে তাঁদের শাসন পদ্ধতিকেও মনের দিক থেকে সমর্থন করতে পারছেন না। তা করলে তারা বিবেকের কাছে আপরাধী হয়ে পড়েন। বিকল্প কোনো রাজনীতির কথা চিন্তা করতে পারেন না। যেহেতু তাদের অনেকেরই আমাদের দেশের জনগণের উপর বিশ্বাস এবং আস্থা খুবই স্বল্প। আসলে তাদের নিজেদের উপরই বিশ্বাস নেই। এই আত্মবিশ্বাসের অভাবেই তারা ইচ্ছার বশেই হোক বা অনিচ্ছায় হোক সামরিক সরকার দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছেন। এখনও ব্যবহৃত হতে পেলে বেঁচে যান।
কিন্তু এ ভিন্ন সময়। আমাদের দেশের প্রতিটি শ্রমিক, প্রতিটি কৃষক নিজের শক্তির মহিমা বুঝেছে। সে হাতে কলমে বুঝেছে তার বন্দুক নিক্ষিপ্ত একটি বুলেটের সঠিক আঘাতে একজন পাকিস্তানী সৈন্য মরেছে। তেমনি আমাদের দেশের প্রতিটি তরুণ দেশপ্রেমিক উপলব্ধি করেছেন তাদের চিন্তা ও কল্পনার বিস্ফোরণের মধ্যেই একটি পুরোনো, সমাজ ধ্বসে যাচ্ছে, একটি নতুন সমাজ সৃজিত হচ্ছে। এই নতুন সমাজে সৃজনের পদ্ধতি থেকেই আমাদের দেশে আসবে নতুন সাহিত্যিক, নতুন কালের কবি, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক। উদ্ভব হবে ঝলমলে সব সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের ।
.
দেশটা যেনো আমাদের নয়। অন্য কেউ অদৃশ্যভাবে এই দেশ শাসন করে। ঠিক রাজনৈতিক অর্থে বলছিনে। ভিন্ন ভিন্ন দেশের রুচি সংস্কৃতির দাসত্ব করি আমরা মনে মনে। অপরের খুশী এবং পছন্দের মাপে আমরা গড়ে উঠি। আমাদের কোনো বিষয়ে জাতীয় কোনো দৃষ্টিভঙ্গী নেই। জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গীর অর্থে অন্ধ এবং অহংপুষ্ট স্বাদেশীকতাসর্বস্ব মনোভাবের কথা বলা আমাদের উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই নয়। সভ্যতার মূলকথা যা-জীবন জড়বস্তুকে শাসন করে, পোষ মানায়। আমাদের প্রতিবেশীদের উপকরণ সংগ্রহ করে এই দেশে একটি সভ্যতা সৃজন করতে পারবো, এই বিশ্বাসে বলীয়ান মানুষের সংখ্যা আমাদের দেশে খুবই বিরল। তাই বিদেশ থেকে বৈদেশিক অর্থ সাহায্যেরে দিকে হাপিত্যেশ করে বসে থাকি যেমন, তেমনি বিদেশী জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প সংস্কৃতির সুফলটুকু ভোগ করেই আমরা মনে করি সুসভ্য হয়ে গেলাম। বিলাত দেশটা যে সত্যি সত্যি মাটির–ঠেকে না শিখলে গোটা জীবনে অজ্ঞই থেকে যেতে হয়।