সমাজের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান। সুতরাং মুসলমান সমাজ থেকে আগত জ্ঞানবান, বিবেকবান, চিন্তাশীলদেরই দায়িত্ব সামাজিক অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং বিবেকহীনতার বিরুদ্ধে তীব্র, তীক্ষ্ণ এবং সপ্রেম বিদ্রোহের আওয়াজ তোলা । মানুষের মন দিয়েই মনের পরিবর্তন সম্ভব। বাহ্যিক সমস্ত প্রচেষ্টা মনের জাগরণ, চৈতন্যের উদ্বোধন ছাড়া ব্যর্থ হতে বাধ্য। কেউ কেউ বলেন, ধন বন্টনের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে ওসব থাকবে না। কিন্তু সাম্য প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই তো সর্বপ্রথম সংস্কারমুক্তির প্রয়োজন। ধর্মীয় সংস্কার এমন জিনিশ যা সোজা জিনিসকে বাঁকা দেখতে বাধ্য করে। এই বাঁকা দেখতে বাধ্য হয়েছিলো বলেই ভারত দ্বি-খণ্ডিত হয়েছে। অনেকে এই কথাটি সহজে বুঝতে চান না বলেই হিন্দু কমিউনিস্ট এবং মুসলমান কমিউনিস্ট শব্দ দুটি আমাদের সমাজে চালু হয়েছে।
এই বাঙলাদেশে যেখানে শতকরা আশিজন মানুষ মুসলমান-আশিজনের মধ্যে উনসত্তর জন সংস্কারান্ধ, সেই সমাজে আজকে যদি একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব সাধনের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়, তার চেহারা কি হবে? ধর্মীয় সমস্ত অনুশাসনের অনেকগুলো কি রদ করতে হবে না? যদি তাই হয়, জোর করে সে সব কি সম্ভব? জ্ঞানের সাহায্যে নিষ্কলঙ্ক মানবতার বাণী প্রচার করে তার কি একটা ক্ষেত্র রচনা করতে হবে না? সে কাজ শিল্পীর, সে কাজ কবির, সে দায়িত্ব ঔপন্যাসিকের। শুধু মুসলমান সমাজ কেনো, হিন্দু সমাজে কি কুসংস্কার নেই? গোটা সমাজদেহে কি বর্ণাশ্রম ধর্ম জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে নেই? হিন্দু সম্প্রদায় থেকে আগত চিন্তাশীল মানুষদের এসবের বিরুদ্ধে ধ্বনি তোলা প্রয়োজন। একইভাবে সাঁওতাল, মগ, গারো, হাজং সকল ধর্মের সকল বর্ণের মানুষের মধ্যে একটা প্রীতির সঞ্চার করা এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, যার প্রভাবে প্রত্যেক সমাজ ভেতর থেকেই সম্প্রদায়গত বদ্ধমতের আবরণ ঠেলে ফেলে দিতে পারবে। এক ধর্ম, এক সম্প্রদায়ের অনাচারের বিরুদ্ধে অন্য সমাজের মানুষের কিছু না বলাও আরেক ধরণের সাম্প্রদায়িকতা। কেননা যে ভাবেই হোক না কেনো যা যে কোনো মানুষের চিন্তা চেতনাকে আবদ্ধ করে রাখে তাকে শোধরাবার চেষ্টা না করা, নিজের জ্ঞান থাকলে সে জ্ঞানের অংশভাগী না করাও মানুষের প্রতি আরেক ধরনের কপটতা। কিন্তু বিপ্লবে কপটতার স্থান নেই। আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থা যে রকম তাতে শুরুতেই এক ধর্মের, এক সম্প্রদায়ের মানুষ অন্যকে উপযাচক হয়ে উপদেশ দিতে গেলে লাভের চাইতে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশী। বাঙলাদেশের মানুষ ধর্মীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সগ্রাম করেছে, তার কাঠামো ভেঙ্গে ফেলেছে। এখন সকল সম্প্রদায়ের মানুষ মিলে বাঙলাদেশে ধর্মের বদ্ধমতগুলো উড়িয়ে দিতে পারলে মানুষে মানুষে অন্তরের মিলনটা সহজ এবং স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। মানুষ শুধু মানুষ এই পরিচয়ে চিহ্নিত করার সর্বাঙ্গীন প্রয়াসটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মূল কথা। আমাদের দেশে সে প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে। যারা বুঝতে চায় না, তারা মূঢ়, দৃষ্টিহীন এবং মানবোচিত প্রেমহীন।
.
আমাদের সমাজের এখন একটি প্রচণ্ড ওলটপালট অবস্থা। একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্বাভাবিক পরিণতি এবং একটি নতুন সমাজ সৃজনের পূর্বশর্ত যদি একে ধরে নেয়া হয়, তাহলে দোষের কিছু নেই। কিন্তু সমস্ত বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে, সমস্ত ভাঙন থেকে সুশৃঙ্খল পরিবেশ বেরিয়ে আসে, ভাঙনের মুখে নতুন চর, নাবাল জমি জাগে একথা তো সত্যি নয়। নৈরাজ্য নৈরাজ্যকেই ডেকে নিয়ে আসে। স্বাধীনতার পর পর একটি শ্রেণীর বদলে আরেক শ্রেণী স্বাভাবিকভাবে জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করার জন্য, ক্ষমতা অপ্রতিহত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া, বন্টন পদ্ধতি, যাবতীয় সামাজিক সম্বন্ধ, বৈদেশিক সম্পর্কের মধ্যেই এই শ্রেণীর বৃদ্ধির উপাদান রয়েছে। এই শ্রেণী যদি তার সপক্ষে যা কিছু আছে, সব কিছুকে ব্যবহার করে গ্যাট হয়ে বসে আমাদের জনগণের কিচ্ছু হবে না। তথাকথিত প্রতিটি জাতীয় সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিটি জাতি যা লাভ করে থাকে, যেমন জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সরকার, তার বেশী পাবেন না। কঠোর বাস্তবের শিক্ষা এই, সুস্থ মানুষ অকারণে কিছু করে না। আমাদের দেশের শ্রমিক-কৃষক নিম্নবিত্ত মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে এই তিন বস্তুর জন্য অংশ গ্রহণ করেছিলেন-এটা কিছুতেই সত্য হতে পারে না। তাদের এই সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করার পেছনে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কারণ বর্তমান ছিলো। রাজনীতিকে জনগণের সর্বাঙ্গীন ভাগ্যের নিয়তি যারা মনে করেন, তাদের কর্তব্য হবে এই বিশৃঙ্খলা, এ অসন্তোষকে সঠিকভাবে প্রবাহিত করিয়ে জনগণের মধ্যে চারিয়ে দিয়ে তাদের সুপ্ত শক্তির বিকাশ সাধন করে স্বাদেশিক এবং বৈদেশিক উভয় অর্থে শোষণহীন একটি সমাজ গঠনের জন্য শরীর এবং মনের দিক থেকে পরিপূর্ণভাবে তৈরি করে তোলা। তা যদি না হয়, তাহলে অপর সম্ভাবনাটিই কার্যে পরিণত হতে খুব বেশী সময়ের প্রয়োজন হবে না।
বাঙলাদেশের বর্তমান সামাজিক নৈরাজ্য সংস্কৃতি চিন্তায়ও প্রভাব বিস্তার করেছে। অনেক চিন্তাশীল মানুষ এখন চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ঠুটো জগন্নাথ হয়ে বসে আছেন। তাঁরা কিছু বলতে চান না। যারা প্রতিক্রিয়াশীল তাদের কথা বলছিনে। তারা তো সব সময়ে নিজের স্বার্থের কথা ভাবেন-এটা একটুও বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু যারা সত্য স্বাধীনতার পূজারী, যারা মনুষকে ভালোবাসেন, যারা নিজের দেশ, জাতি এবং দেশের মানুষকে ভালোবাসেন, তাঁরাও কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছেন। কারণ, কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায় এ সময়ে চেনা অনেকটা কঠিন। তাই ভালো কথা বললেও তার প্রতিক্রিয়া খারাপ হবে মনে করে চুপ থাকা শ্রেয় মনে করেছেন। এঁরা প্রকারান্তরে এই নৈরাজ্যের শক্তির কাছেই আত্মসমর্পন করেছেন। তাঁদের মনোভাব মারাত্মক। কেননা, রোগ যখন প্রবল, জোরালো ওষুধের প্রয়োজন তখন বেশী। যখন পারিপার্শ্বিকার কারণে স্থির চিন্তা করা একরকম অসম্ভব, তখনই স্থির চিন্তা করার সময়। নৌকা যখন ঝড়ে পড়ে, তখনই দৃঢ়ভাবে হাল ধরে ঠাণ্ডা মাথায় তীর লক্ষ্য করে বাইতে হয়। নচেত যে বিপদের মধ্যে তরী দুলছে, সে বিপদেই গ্রাসিত হবার সম্ভাবনা অত্যধিক।